একটি সঠিক মার্কেটিং প্ল্যান বা বিপণন পরিকল্পনা যেহেতু একটি ব্যবসার সাফল্যের রোডম্যাপ হিসাবে কাজ করে তাই এর গুরুত্ব বলে শেষ করা যাবে না। একটি ব্যবসাকে সঠিক ও নির্বিঘ্নভাবে পরিচালনার জন্য এবং ব্যবসার সফলতা অর্জনের জন্য মার্কেটিং প্ল্যানের গুরুত্ব অনেক।
অসংখ্য গুরুত্বের মধ্যে কয়েকটি হলো-
- ব্যবসার অবস্থান সম্পর্কে সঠিক ধারণা দেয়
- টার্গেট মার্কেট সম্পর্কে জানা যায়
- পরিকল্পিত বাজেট তৈরিতে সাহায্য করে
- ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা তৈরিতে সাহায্য করে
- ব্যবসার সময় ও খরচ বাঁচায়
- প্রতিযোগীদের সম্পর্কে ধারণা দেয়
- নিজস্ব অবস্থান ধরে রাখতে সাহায্য করে
- ঝুঁকি এড়াতে সাহায্য করে
- সঠিকভাবে সম্পদ বরাদ্দে ভূমিকা রাখে
- অভিযোজন (Adaptability) ক্ষমতা বাড়ায়
নিচে এই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করা হলো-
১. ব্যবসার অবস্থান সম্পর্কে সঠিক ধারণা দেয়ঃ
মার্কেটিং প্ল্যান একটা ব্যবসাকে প্রচারের জন্য করণীয় বিষয়ের প্রতি স্বচ্ছ ধারণা প্রদান করে। বর্তমানে ব্যবসার অবস্থান কেমন সেটা সম্পর্কে জানা যায়। ঠিক তেমনি একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ব্যবসার প্রচারণাকে কোথায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব তার প্রতিরূপ মার্কেটিং প্ল্যানের মাধ্যমে পাওয়া যায়।
অর্থাৎ, ব্যবসায় প্রসারের দিকনির্দেশনা একটি মার্কেটিং প্ল্যানের মাধ্যমে লিপিবদ্ধ করা যায়। তাতে করে আপনি যা অর্জন করতে চান সেখানে কিভাবে পৌঁছাবেন সে সম্পর্কে প্রথম থেকে অবগত থাকা যায়।
যেমন, বাজার করতে যাবার আগেই আমরা কোন জিনিসগুলো কিনতে হবে তার একটা তালিকা তৈরি করে নিই। এই তালিকা আমাদেরকে বুঝতে সাহায্য করে কতগুলো পণ্য কিনতে হবে এবং তার জন্য কোথায় কোথায় যেতে হবে। এই পরিকল্পনাটি আগেই মাথায় না থাকলে হয়রানি হবার আশঙ্কা বেড়ে যায়।
আরো পড়ুন: মার্কেটিং স্ট্রাটেজি কি? কিভাবে এটি তৈরি করা হয়? এর গুরুত্ব
২. টার্গেট মার্কেট সম্পর্কে জানা যায়ঃ
মার্কেটিং এর সকল গুরুত্বপূর্ণ দিকের মধ্যে টার্গেট মার্কেট অন্যতম। মার্কেটিং প্ল্যান এখানে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি বুঝতে সাহায্য করে একটা ব্যবসার গ্রাহক বা ভোক্তা কারা।
প্রথমত, নির্দিষ্ট ব্যবসাটির গ্রাহক কে সে সম্পর্কে মার্কেটিং প্ল্যান ধারণা দেয়। এরপর এটা বুঝতে সাহায্য করে এই গ্রাহকের কাছে কিভাবে পৌঁছানো যায়। পরবর্তীতে সেই গ্রাহককে স্থায়ী করতে করনীয় বিষয় সম্পর্কে অগ্রীম ধারণা মার্কেটিং প্ল্যানের মাধ্যমেই চলে আসে।
একইভাবে, টার্গেট অডিয়েন্স বা ভোক্তা সম্পর্কে ধারণা রাখতে গেলে তাদের চাহিদা সম্পর্কে জানতে হয়। এই চাহিদার বিষয়গুলো ভালো করে ঘাটতে গেলেই বেরিয়ে আসে তাদের পছন্দ বা রুচির বিষয়টা। তারপর থাকে ভোক্তার আচরণগত বৈশিষ্ট। এসব বিষয় জানার মাধ্যমেই কোনো ব্যবসায় তার নির্দিষ্ট লক্ষ্যে সহজভাবে এগিয়ে যেতে থাকে।
একটা ছোট্ট উদাহরণ হিসেবে আমরা দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে নিতে পারি। ফেইসবুকে (Facebook) কোনো বিষয় বা পণ্য খুঁজতে থাকলে ওই ধরণের অনেক সাজেশন পাওয়া যায়। ওই মুহূর্তে ফেইসবুক আমাদের চাহিদা বা রুচি সম্পর্কে অবগত হয় বলেই অন্যান্য পণ্যকে আমাদের সামনে নিয়ে আসে।
বলা যায়, ভোক্তা সম্পর্কে যত ধারণা পাওয়া সম্ভব তত সহজভাবে পণ্যের প্রচার করা সম্ভব। আর এই কাজটা করার জন্য মার্কেটিং প্ল্যানের গুরুত্ব বলে শেষ করা যায় না।
৩. পরিকল্পিত বাজেট তৈরিতে সাহায্য করেঃ
যেহেতু মার্কেটিং প্ল্যান এক ধরনের পরিকল্পনা তাই এই বিষয়টা যে আগত পরিস্থিতি সম্পর্কে অনুমান করতে সাহায্য করে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কোথায় কতটা বিনিয়োগ করতে হবে এটা জানলে যেমন অর্থের পরিমাপ অনুমান করা যায়, ঠিক সেভাবেই পণ্যের উৎপাদন ও প্রচারের ধারণা বলে দেয় কতটা মূনাফা পাওয়া সম্ভব।
মার্কেটিং প্ল্যান গুরুত্ব রাখে ফান্ডিং পেতে। যতটা পরিষ্কার ধারণা একটি মার্কেটিং প্ল্যানের মাধ্যমে একজন ইনভেস্টর পাবে, সে ততটা আস্থা আনতে পারবে ওই কোম্পানির প্রতি। এতে করে বিনিয়োগে বাধা পড়ার ঝুঁকি কমে।
ব্যবসার অগ্রগতি কেমন হচ্ছে তার একটা ট্র্যাক মার্কেটিং প্ল্যানের দ্বারা জানা সম্ভব। এর ফলে, মার্কেটিং স্ট্রাটেজি পরিবর্তন করা লাগবে কিনা সেটা বুঝতে পারা যায়। আর এই তথ্য উপাত্তগুলো মার্কেটিং প্ল্যানের মাধ্যমে পাওয়া সহজ হয়।
৪. ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা তৈরিতে সাহায্য করেঃ
একটি মার্কেটিং প্ল্যান ব্যবসার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা তৈরিতে সাহায্য করে। বর্তমান অবস্থানকে কেন্দ্র করে ভবিষ্যতে কোন বিষয় মাথায় রেখে আগাতে হবে সে ব্যাপারে সঠিক ধারণা প্রদান করে।
ব্যবসায় প্রতিনিয়ত একটু একটু করে প্রসারিত হতে থাকে এবং প্রচারের বিষয়গুলো সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তন হয়। একটি মার্কেটিং প্ল্যান এই সময়ের চাহিদাগুলোকে একটা ফ্রেমে আটকাতে সাহায্য করে।
ভবিষ্যতে কোনো পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নিতে বর্তমান অবস্থানের লিপিবদ্ধ বিষয়গুলো খুব স্পষ্ট ধারণা দেয়। এতে করে ব্যবসায় প্রচারণার আত্মবিশ্বাস বাড়ে।
আরো পড়ুন: বাংলাদেশে ই-কমার্স - বিভিন্ন ধরণ, সফলতা, ভবিষ্যৎ এবং এর চ্যালেঞ্জ
৫. ব্যবসার সময় ও খরচ বাঁচায়ঃ
একটা পরিষ্কার মার্কেটিং প্ল্যান মূল্যবান সময় বাঁচাতে গুরুত্ব রাখে। অযথা নানা দিন চিন্তা না করে বা এদিক ওদিক না ঘুরে একটি লিপিবদ্ধকৃত সঠিক পরিকল্পনাই দিতে পারে অল্প সময়ে বেশি সমাধান।
মার্কেটিং প্ল্যানের মাধ্যমে প্রচারণার পথগুলো যখন এক নজরে দেখে নেয়া যায় তখন খুব কম সময়ে তা বোধগম্য হয়। এক একটা করে বিষয়ের উপর নজর না দিয়ে তখন অনেকটা জায়গার প্রতি একবারে চোখ বুলিয়ে নেয়া যায়।
একইভাবে, এই প্ল্যান খরচ বাঁচাতে সাহায্য করে। যখনই পুরো পরিকল্পনা সম্পর্কে ধারণা আগে থেকেই পাওয়া যায়, তখন বোঝা যায় ঠিক কতটা খরচ করতে হবে। এতে করে নির্দিষ্ট খরচের বাইরে ব্যবসাকে যেতে হয় না।
৬. প্রতিযোগীদের সম্পর্কে ধারণা দেয়ঃ
ব্যবসায় মানেই প্রতিযোগীতার বাজারে নিজেকে টিকিয়ে রাখা। কোনো কিছু সম্পর্কে ধারণা ছাড়া রেইসে (Race) নেমে গেলে তাতে খুব বেশিক্ষণ দৌড়ানো যায় না। বাজারের ধরণ, ক্রেতা, চাহিদা এবং তার প্রতিযোগীতা সম্পর্কে পুঙ্খানুপুঙ্খ ধারণা থাকলেই তা টিকে থাকতে সাহায্য করে।
এই মার্কেটিং প্ল্যান এমন মুহূর্তে প্রতিযোগীতাকে সহজ করে দেয় এবং নিজের ব্র্যান্ডকে আলাদা করতে সাহায্য করে। যখনই প্রতিযোগী ব্যবসায় সম্পর্কে জানা যায় তখন নিজের ব্যবসার আকর্ষণীয় দিক ভোক্তার সামনে তুলে ধরা সহজ হয়।
৭. নিজস্ব অবস্থান ধরে রাখতে সাহায্য করেঃ
একটা ব্যবসার গতিকে সচল রাখতে পেছন থেকে মার্কেটিং প্ল্যান ব্যাপকভাবে কাজ করে। সম্পূর্ণ বিকশতি একটা ব্যবসায় মার্কেটিং প্ল্যান ছাড়া হঠাত করেই স্থানচ্যুত হয়ে যেতে পারে।
ব্র্যান্ড ভ্যালু (Brand Value) তৈরি করা এবং সেটার ধারাবাহিকতা রক্ষায় সবচে বেশি কাজ করে থাকে সঠিক পরিকল্পনা। তবেই ভোক্তা সেই ব্যবসার উপর আস্থা রাখতে পারে। একই সাথে সেই ব্যবসার মান এবং পরিচয় সম্পর্কে আলাদা জায়গা তৈরি হয়।
যেমন, কোনো রেস্টুরেন্ট হয়তো কিছু সময় ধরে ভালো ব্যবসায় করছে। এর মধ্যেই প্রতিযোগীতার বাজারে তার পণ্যের মানকে সে আলাদা করতে না পারায় হারাতে পারে বিশেষ কিছু ভোক্তা।
অথবা বলা যেতে পারে, কোনো দোকানে কেনাকাটা করতে যেয়ে একজন ভোক্তা প্রথমে যেমন বোধ করতো পরবর্তীতে আচরণগত কারণে তা আর পায় না। ওই দোকান সম্পর্কে হঠাত তার একটা বিরূপ মনোভাব সৃষ্টি হতে পারে।
তাই, মার্কেটিং পরিচালনার জন্য পণ্যের মানের সাথে আচরণবিধির ধারাবাহিকতা অনেক সূক্ষ্মভাবে কাজ করে। মার্কেটিং প্ল্যান থাকলে এই বিষয়গুলো সম্পর্কে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব হয়।
আরো পড়ুন: ব্র্যান্ডিং কাকে বলে? কিভাবে শিখবেন এবং সফল ব্র্যান্ডিং কিভাবে করবেন
৮. ঝুঁকি এড়াতে সাহায্য করেঃ
একটা মার্কেটিং প্ল্যান ব্যবসার আসন্ন ঝুঁকির জন্য আগে থেকে প্রস্তুত হতে সাহায্য করে। যে কোনো ব্যবসায় সামনে এগিয়ে যেতে শুরু করলে বিভিন্ন ধরনের বাধার সম্মুখীন হয়। আগে থেকেই সেই বাধা সম্পর্কে অনুমান পেতে সাহায্য করে মার্কেটিং প্ল্যান।
এতে করে সম্ভাব্য ঝুঁকিকে কেন্দ্র করে তা সমাধানের ব্যবস্থা আগে থেকে গ্রহণ করা যায়। এটি একটি ব্যবসাকে সব দিক থেকে প্রস্তুত করে তোলে। শক্তিশালী হয়ে কিভাবে সমস্যার মোকাবেলা করা যায় তা সম্পর্কে প্রস্তুতি নেয়ার সময় দেয়।
৯. সঠিকভাবে সম্পদ বরাদ্দে ভূমিকা রাখেঃ
একটি মার্কেটিং প্ল্যান সাহায্য করে কোন কোন খাতে একটা ব্যবসার পণ্যকে প্রচারণার জন্য বরাদ্দ করতে হবে। সময় এবং বাজেটকে কেন্দ্র করে কোন মাধ্যমগুলো সেই ব্যবসার প্রচারণার জন্য সঠিক হবে তার ধরণা দেয় মার্কেটিং প্ল্যান।
পাশাপাশি, কত রকমের কৌশল ওই ব্যবসায় প্রচারণার জন্য অবলম্বন করা যেতে পারে তার একটা ধারণা পাওয়া যায়। শুধু প্রচারণার কৌশল সম্পর্কেই নয় বরং সেই কৌশল ব্যবহার করে কোম্পানিতে কতটা লভ্যাংশ তুলে আনা যায় সে বিষয় সম্পর্কে বোঝা যায়। সে অনুযায়ী সবচেয়ে শক্তিশালী প্রচেষ্টাগুলো নিয়ে কাজ করার ক্ষমতা বেড়ে যাবে।
মূলধনের কতটা কোন খাতে খরচ হচ্ছে এবং তা কতটা সময় নিয়ে লাভসমেত ফিরে আসতে পারে এই নকশা একটা ব্যবসাকে প্রাঞ্জল করে তোলে। এই কাজটাকে গুছিয়ে তুলতে মার্কেটিং প্ল্যানের গুরুত্ব অনেক বেশি।
১০. অভিযোজন (Adaptability) ক্ষমতা বাড়ায়ঃ
বাজারের বিষয়গুলো দ্রুত পরিবর্তনশীল। সময়ের সাথে সাথে মানুষের রুচির বা স্বভাবের পরিবর্তন আসে। বাজার অনুযায়ী ব্যবসাকে গোছানো বা পরিবর্তন করার লক্ষ্যে সে ব্যবসার অভিযোজন ক্ষমতা থাকতে হয়। এই কাজটা মার্কেটিং প্ল্যানের মাধ্যমেই সম্ভব হয়।
মার্কেটিং প্ল্যানের দ্বারা কোম্পানির জন্য করা পরিকল্পনাকে প্রয়োজন মাফিক সংশোধন করা যায়। গোটা স্ট্রাটেজিকে ৩৬০ ডিগ্রি ঘুরিয়ে ব্যবসাকে হুমকির হাত থেকে বাঁচানো সম্ভব হয়। এরকম ক্রুশাল (Crucial) সময়ে অ্যাডাপ্টিবিলিটি ধরে রাখা কষ্ট হয়ে যায় যদি না একটা ভালো মার্কেটিং প্ল্যানের সহযোগীতা নেয়া হয়।
একমাত্র পূর্ব-পরিকল্পনাই এমন সময় ধৈর্য্য ধারণে ভূমিকা রাখে। নিজস্ব প্রচারণার পরিকল্পনা ব্যবসার আত্মবিশ্বাসকে ধরে রাখে।