একটি ব্যবসায় শুরু করার সময় প্রথমেই চিন্তা করা হয় সেই ব্যবসার প্রসার কিভাবে করা যায়। যে পণ্য বা সেবা নিয়ে আপনি বাজারে নিজের অবস্থান তৈরি করতে চাচ্ছেন তা ভোক্তা পর্যন্ত কিভাবে পৌঁছাবে সেটা জানা খুব জরুরি। এই কাজটা করে থাকে ব্যবসায় প্রচারণা বা মার্কেটিং।
তবে, মার্কেটিং কে সহজ করতে প্রয়োজন হয় সঠিক পরিকল্পনার। চলুন জেনে নেয়া যাক মার্কেটিং প্ল্যান আসলে কি?
মার্কেটিং প্ল্যান বা বিপণন পরিকল্পনা কি?
মার্কেটিং প্ল্যান (Marketing Plan) হলো একটি কোম্পানির এমন একটি প্রতিবেদন যা ওই কোম্পানির পণ্যকে কিভাবে প্রচার করতে হবে তার সঠিক ধারণা প্রদান করে। অর্থাৎ, যেখানে একটি সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে কোনো পণ্যকে প্রচার করার যাবতীয় বিষয় আলোচনা করা হয় সেটিই ওই ব্যবসার মার্কেটিং প্ল্যান।
সাধারণত, মার্কেটিং প্ল্যানের মধ্যে কোম্পানির নিজস্ব অবস্থানের বিষয়গুলো উল্ল্যেখ থাকে। যা পরবর্তীতে কোন ধরনের কৌশল অবলম্বন করে ব্যবসাকে সামনে এগিয়ে নেয়া যায় সে বিষয়ে ধারণা দেয়। এর পাশাপাশি কোম্পানির ব্র্যান্ড পরিচয় ফুটিয়ে তুলতে প্রচারণার মাধ্যমগুলোর উপর গুরুত্ব প্রদান করে।
মার্কেটিং প্ল্যান ও মার্কেটিং স্ট্রাটেজিঃ
খুব কাছাকাছি শব্দ হওয়ায় মার্কেটিং প্ল্যান এবং মার্কেটিং স্ট্রাটেজি এ দুটো টার্মকে এক ভেবে ফেলার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু, বিষয় দুটো বেশ আলাদা। মার্কেটিং প্ল্যান একটি ব্যবসার মার্কেটিং স্ট্রাটেজির আগের ধাপ।
একটু বুঝিয়ে বললে, একটি ব্যবসার পণ্যকে কিভাবে প্রচার করা যায় তার একটা খসড়া দাঁড় করানো হলো মার্কেটিং প্ল্যান। যেমন মনে করুন, আপনার ব্যবসার পণ্যকে আগামী এক মাস বা এক বছরের মধ্যে আপনি কোথায় এবং কতটুকু প্রচার করতে পারবেন তার ধারণা তৈরি করে নিলেন।
এরপর, সেই খসড়া অনুযায়ী ধাপে ধাপে এগিয়ে যাওয়া হচ্ছে মার্কেটিং স্ট্রাটেজি। যে কৌশলগুলোর মাধ্যমে আপনার ব্যবসার পণ্য আপনি ভোক্তা পর্যন্ত প্রচার করতে পারছেন সেটাই এখানকার বিবেচ্য বিষয়।
তাই বলা যায়, মার্কেটিং প্ল্যান তৈরি করা সহজ হয় যদি সেই ব্যবসার মার্কেটিং স্ট্রাটেজি কেমন হবে তা আগে থেকেই মাথায় রাখা হয়।
বিভিন্ন ধরনের মার্কেটিং এর পদ্ধতি
মার্কেটিং একটি ব্যবসার পণ্যকে প্রচার করা থেকে শুরু করে এর ব্র্যান্ডের পরিচয় তুলে ধরা, গ্রাহকদের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখা, বিক্রয়ের গতি বাড়ানো এবং লক্ষ্যে পৌঁছাতে সাহায্য করে। তবে এই Marketing বিভিন্ন উপায়ে করা হয়ে থাকে। অতীতে এক রকম করে ব্যবসার প্রচার করা হতো। সময়ের পরিবর্তে তা এখন অনেকটা পরিবর্তন হয়েছে।
মার্কেটিং এর কিছু সাধারণ পদ্ধতিগুলো হতে পারে-
- ট্রেডিশনাল মার্কেটিং (Traditional Marketing)
- ডিজিটাল মার্কেটিং (Digital Marketing)
- কন্টেন্ট মার্কেটিং (Content Marketing)
- সোশাল মিডিয়া মার্কেটিং (Social Media Marketing)
- সার্চ ইঞ্জিন মার্কেটিং (Search Engine Marketing; SEM)
- ই-মেইল মার্কেটিং (E-mail Marketing)
- ইনফ্লুয়েন্সার মার্কেটিং (Influencer Marketing)
- এফিলিয়েট মার্কেটিং (Affiliate Marketing)
- ইভেন্ট মার্কেটিং (Event Marketing)
- সরাসরি মার্কেটিং (Direct Marketing)
নিচে এই মার্কেটিং এর বভিন্ন পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করা হলো-
১. ট্রেডিশনাল বা প্রথাগত মার্কেটিং (Traditional Marketing)
প্রথাগত মার্কেটিং বা Traditional Marketing বলতে এমনসব বিপণন কৌশলকে বোঝায় যা ইন্টারনেট বা ডিজিটাল মিডিয়ার আগমনের পূর্বে থেকেই প্রচলিত হয়ে আসতেছে।
প্রথাগত মার্কেটিং সাধারণত টেলিভশন, রেডিও, বিলবোর্ড, প্রিন্ট মিডিয়া যেমনঃ সংবাদপত্র, ম্যাগাজিন, ব্রোশিওর বা Flyer এর মাধ্যমে করা হয়। স্থানীয় বাজার এবং সরাসরি গ্রাহকদের কাছে পোঁছানোর জন্য এই Marketing পদ্ধতি খুবই কার্যকর।
২. ডিজিটাল মার্কেটিং (Digital Marketing):
ইন্টারনেট বা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে পণ্য বা সেবা গ্রাহকদের নিকটে প্রচার করারকে ডিজিটাল মার্কেটিং বলা হয়। আরেক ভাবে একে অনলাইন মার্কেটিং বা Online Marketingও বলা হয়ে থাকে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম অর্থাৎ ফেইসবুকে (Facebook) পেইজ খোলার মাধ্যমে বর্তমানে ডিজিটাল Marketing অনেক সহজভাবে প্রতিটি মানুষের হাতের নাগালে এসেছে।
এছাড়া, নির্দিষ্ট পণ্যের ওয়েবসাইট (Website) তৈরি করে বা ডিজিটাল যেকোনো ধরণের চ্যানেলের মাধ্যমে এই বিপণন পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
আরো পড়ুন: ব্র্যান্ডিং কাকে বলে? সফল ব্র্যান্ডিং কিভাবে করবেন
৩. কন্টেন্ট মার্কেটিং (Content Marketing):
কন্টেন্ট মার্কেটিং ডিজিটাল মার্কেটিং এর মতো করেই বিভিন্ন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে পণ্যের বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে থাকে। এই Marketing পদ্ধতিতে পণ্য সম্পর্কে ভোক্তা বিস্তারিত জানতে পারে, ছবি দেখতে পারে এবং অন্যান্য ভোক্তার মতামতও জানতে পারে।
কন্টেন্ট সাধারণত লিখিত উপাদান বা ছবি হতে পারে, আবার ভিডিওগ্রাফিও হতে পারে। এর মাধ্যমে একজন ভোক্তার নির্দিষ্ট ব্র্যান্ড সম্পর্কে আরও বিস্তারিত তথ্য লাভ করতে সক্ষম হয়।
যেকোনো কোম্পানির ব্লগ পোস্ট বা নানা রকম ইনফোগ্রাফির মাধ্যমে প্রচারিত তথ্যই হতে পারে ওই কোম্পানির কন্টেন্ট মার্কেটিং।
৪. সোশাল মিডিয়া মার্কেটিং (Social Media Marketing):
সোশাল মিডিয়া অর্থাৎ সরাসরি ফেইসবুক, ইন্সটাগ্রাম (Instagram), লিংকড ইন (LinkedIn), Tiktok, Pinterest ইত্যাদি ব্যবহার করে পণ্যের যে প্রচারণা করা হয় সেটাই সোশাল মিডিয়া মার্কেটিং। এই Marketing ডিজিটাল মার্কেটিং এর একটি অংশ।
এ ধরনের মার্কেটিং পদ্ধতিতে ভোক্তার সাথে সরাসরি সম্পর্ক বজায় রাখা সহজ হয়। সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে সবচে গুরুত্বপূর্ণ কাজটা এ ধরণের মার্কেটিং এ জানা যায়, তা হলো ভোক্তার রুচি।
হরেক রকম বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে ভোক্তার আকর্ষণ টেনে নেয়া, লাইভ করে অডিয়েন্সের সাথে অনেক সময় ধরে যুক্ত থাকা, মেসেজিং (Messaging) করা বা বিভিন্ন ইভেন্ট হোস্ট করার মাধ্যমে এ মার্কেটিং চালানো হয়। ভোক্তাকে নিজের পণ্যের প্রতি ধরে রাখাই এর মূল লক্ষ্য।
৫. সার্চ ইঞ্জিন মার্কেটিং (Search Engine Marketing SEM):
সার্চ করার বা পণ্য খোঁজার জন্য এই ডিজিটাল যুগে ভোক্তা সাহায্য নেই কোনো অপারেশন মাধ্যম। কোনো ওয়েবসাইটে প্রচারিত পণ্যকে সার্চ করলে ভোক্তার সামনে নিয়ে আসার বিষয়টা হলো সার্চ ইঞ্জিন মার্কেটিং।
কী দিয়ে সার্চ করতে পারে এমন আনুমানিক কিছু শব্দ ব্যবহার করে একটা ফলাফলে দাঁড় করানো সম্ভব হয় এই Marketing দ্বারা। অনেক কন্টেন্টের ভীড়ে সবার আগে যেন নিজের কন্টেন্টটি ভোক্তার কাছে পৌঁছানো যায় এ বিষয়কে সামনে রেখে কাজ করে সার্চ ইঞ্জিন মার্কেটিং।
৬. ই-মেইল মার্কেটিং (E-mail Marketing):
পণ্য সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য দিয়ে ই-মেইল প্রেরণের মাধ্যমে গ্রাহকের নিকট পোঁছানো এবং তাদের সাথে একটি সম্পর্ক তৈরির চেষ্টার মাধ্যম হলো ই-মেইল মার্কেটিং। টার্গেট অডিয়েন্স সনাক্ত করার পর কোম্পানি সম্পর্কে ও এর পণ্য বা সেবা সম্পর্কে ই-মেইল ব্যবহারকারীদের কাছে তা পৌঁছে দেয়ার কাজটা এই Marketing সহজ করে।
এতে করে, অনেকেই যারা সার্চ করে পণ্যকে দেখছে না তাদেরকে রিচ (Reach) করার সভাবনা বেড়ে যায়। আবার কখনো কখনো যে ভোক্তারা ওই নির্দিষ্ট পণ্য ব্যবহারকারী হয়ে থাকেন ই-মেইলের মাধ্যমে নতুন জিনিস সম্পর্কে তাদেরকে আপডেট করা হয়।
আরো পড়ুন: ব্যবসা পরিকল্পনার ধাপ সমূহ এবং শুরু করার আগে যে ১২টি বিষয় মনে রাখা জরুরি
৭. ইনফ্লুয়েন্সার মার্কেটিং (Influencer Marketing):
ইনফ্লুয়েন্সার বা যারা মানুষকে প্রভাবিত করতে পারে তাদের দ্বারা পণ্যকে প্রচার করানোর মাধ্যমে তাদের ফলোয়ার বা অডিয়েন্সের কাছে পৌঁছে দেয়ার নামই ইনফ্লুয়েন্সার মার্কেটিং।
সাধারণত, এ কাজগুলো সেলিব্রেটিদের (Celebrity) মাধ্যমে করা হয়ে থাকে। ইদানিংকালে অবশ্য সোশাল মিডিয়াকে কেন্দ্র করেই তৈরি হচ্ছে সোশাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সার।
মনে করুন, ৫ লাখ মানুষ কোনো একটা মডেলকে পছন্দ করে। তার সাজসজ্জা বা লাইফস্টাইলকে সেই ৫ লাখ মানুষ অনুসরণ করে। সেই মডেল যখন কোনো পণ্যকে প্রচার করে থাকে তখন সেটা ওই নির্দিষ্ট সংখক মানুষের মধ্যে প্রচার হয়ে যায়। এভাবেই Marketing এর কাজটি অনেকাংশে সহজ হয়ে যায়।
৮. এফিলিয়েট মার্কেটিং (Affiliate Marketing):
এফিলিয়েট মার্কেটিং হলো একটি পারফর্ম্যান্স ভিত্তিক বিপণন পদ্ধতি। প্রকাশক বা প্রভাবকদের প্রচেষ্টার মাধ্যমে কোনো ওয়েবসাইটে ট্রাফিক অর্থাৎ ভোক্তা আসা শুরু করে এই পদ্ধতি অবলম্বন করে।
কোনো নির্দিষ্ট একটি প্রতিষ্ঠান কিছু শর্তের মাধ্যমে তার পণ্যকে অন্য প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে বিক্রি করার সুযোগ করে দেয় এখানে। আর এই সম্পূর্ণ পদ্ধতি নির্ধারিত কমিশনের মাধ্যমে হয়ে থাকে।
৯. ইভেন্ট মার্কেটিং (Event Marketing):
ব্যবসায়ীক বিভিন্ন অনুষ্ঠান, সম্মেলন, বা স্পন্সরশীপের (Sponsorship) মতো ইভেন্ট হোস্ট করার মাধ্যমে পণ্যকে ভোক্তা সাধারণের সামনে নিয়ে আসাকে বলে ইভেন্ট মার্কেটিং।
এর মাধ্যমে একটি বুথের সাহায্য নিয়ে পণ্য প্রদর্শন করা হয়। কোনো নির্দিষ্ট পৃষ্ঠপোষক থাকলে তাদেরকে উদ্দেশ্য করে প্রচারের ধরণ তৈরি হয়। ইভেন্ট মার্কেটিং এর মাধ্যমে ভোক্তাকে কোনো পণ্য সম্পর্কে সরাসরি ধারণা দেয়া হয়ে থাকে।
১০. Direct বা সরাসরি মার্কেটিং
নির্দিষ্ট স্থানে সরাসরি গ্রাহকদের নিকট পণ্য বা সেবা সম্পর্কে প্রচারণা চালানোর মাধ্যমে এই বিপণন করা হয়ে থেকে। বিভিন্ন শপিংমল, সমাবেশ স্থান, এবং পাবলিক প্লেস এ বিভিন্ন অফার এর মাধ্যমে এই ধরণের Marketing চালানো হয়।
মার্কেটিং এর অনেক পদ্ধতির মধ্যে এগুলো কয়েকটি উদাহরণ হতে পারে। এগুলো ছাড়াও টেলি Marketing বা ওয়ার্ড অব মাউথ মার্কেটিং (Word of Mouth Marketing) এর মতো পদ্ধতিগুলো অনেক জনপ্রিয়।
প্রতিটি মার্কেটিং পদ্ধতির উদ্দেশ্য থাকে কোনো ব্যবসাকে শক্তিশালী করা এবং সেই ব্যবসার পণ্য বা সেবাগুলোকে ভোক্তা পর্যন্ত পোঁছানোর পথকে সহজ করে তোলা।
তাই, কোনো ব্যবসায় প্রচারণার আগে কোন কোন বিপণন পদ্ধতি অবলম্বন করা উচিত সে সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকা উত্তম।