দারিদ্র বিমোচন কিংবা কর্ম সংস্থান তৈরি কিংবা আর্থ-সামাজিক উন্নতি উদ্দেশ্য যাই হোক না কেনো- সমবায় সমিতি যে আমাদের সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তনে খুবই গুরুত্বপুর্ণ ভুমিকা পালন করে, এই ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু একটি সমবায় কীভাবে কাজ করে, এর সুবিধা-অসুবিধা কিংবা আইন সম্পর্কে ধারনা না থাকলে এই প্রতিষ্ঠানের সুফল ভোগ করা সম্ভব না। এর থেকে পর্যাপ্ত সুফল পেতে হলে এই সকল ব্যাপারে নিজে জানা এবং অন্যকে জানানো গুরুত্বপুর্ণ।
সমবায় সমিতি যেভাবে কাজ করে:
সমবায় সমিতির মূল লক্ষ্য যেহেতু একত্রিতভাবে কাজ করে মুনাফা অর্জন করা সেহেতু এখানে যে সিদ্ধান্তই নেওয়া হয় তা সম্মিলিতভাবে নেওয়া হয়। সকলে মিলিতভাবে এখানে সাপ্তাহিক কিংবা মাসিক সভার আয়োজন করে। এর পরে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াবলি ও সমস্যা নিয়ে আলোচনা করা হয়।
সকল সদস্য সমস্যা সমাধানে বিভিন্ন পরামর্শ প্রদান করে কিংবা পরিচালনা পরিষদ থেকে নেওয়া সিদ্ধান্ত সকলের সামনে উপস্থাপন করা হয়। এর পরে যে প্রস্তাবে বেশিরভাগ মানুষের সম্মতি রয়েছে সেই প্রস্তাব গৃহীত হয়।
তবে অনেকক্ষেত্রে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডেও সমবায় সমিতি সমূহ কাজ করে থাকে। যেমনঃ-রাস্তাঘাট মেরামত, পুল নির্মান,দরিদ্রদের সাহায্য সহ অনেক কাজ করে । অনেক সমিতি দরিদ্র মানুষদেরকে সহজ শর্তে লোন দিয়ে থাকে। কিছু কিছু সমিতি গরিব শিক্ষার্থীদের পড়ার খরচ বহন করে এবং বিভিন্ন রকম প্রশিক্ষণেরও আয়োজন করে।
সমিতি গঠন প্রক্রিয়া
সমবায় সমিতি এমন একটি প্রতিষ্ঠান যা গঠন করতে হলে ২০০১ সালে পাশ হওয়া সমবায় আইন অনুসারে করতে হয়। মুলতঃ চারটি ধাপ পার করে একটি সমবায় সমিতি তৈরি করা হয়। ধাপগুলো হলো:
- উদ্যোগ গ্রহণ
- নিবন্ধনের জন্য আবেদন
- নিবন্ধনপত্র সংগ্রহ
- কার্যারম্ভ
উদ্যোগ গ্রহণ:
সমবায় সমিতি গঠণ করতে হলে একই পেশা কিংবা সমমনা এবং একটি নির্দিষ্ট এলাকার কমপক্ষে ২০জন মানুষকে একত্রিত হতে হয়। প্রাথমিকভাবে একত্রিত এই মানুষগুলোকে বলা হয় প্রবর্তক বা উদ্যোক্তা।
পরবর্তীতে এই ২০জন থেকে কমপক্ষে ৬জন সদস্যকে নির্বাচিত করা হয়। এদের দ্বারা সমবায় সমিতি পরিচালনা পরিষদ গঠিত হয়। এই ৬ জন নিন্মোক্ত পদ সমূহ পুরণ করে:
- চেয়ারম্যান - ১ জন
- ভাইস-চেয়ারম্যান - ১ জন
- কোষাধক্ষ - ১ জন
- সেক্রেটারি - ১ জন
- সদস্য - ২ জন
এই কমিটির দ্বায়িত্ব হলো খসরা উপবিধি তৈরি করা। এর পাশাপাশি তারা সকল উদ্যোক্তাদের নাম, ঠিকানা, পেশা, সমিতির মোট মুলধনের পরিমাণ ইত্যাদি ঠিক করে। এই সময়ের সমিতির নামাঙ্গিত সীলমোহর তৈরি করতে হয়। তবে খসরা উপবিধি তৈরি না করে সমবায় বিভাগ থেকে তৈরি করা উপবিধি সংগ্রহ করে তা মেনে চলার অঙ্গিকার করেও উদ্যোগ গ্রহণ করা যায়।
নিবন্ধনের জন্য আবেদন
এই পর্যায়ে সমিতির কর্মকর্তারা সমবায় অফিস থেকে ফর্ম সংগ্রহ করার পরে তা পুরণ ও জমা দেওয়ার মাধ্যমে নিবন্ধনের কার্যক্রম শুরু করে। তবে এই সময় আবেদন পত্রের সাথে কিছু কাগজ সংযুক্ত করা হয়:
- প্রস্তাবিত সমিতির সদস্যদের নাম, ঠিকানা ও তারিখসহ স্বাক্ষর সম্বলিত কাগজ;
- উদ্যোক্তাদের স্বাক্ষরসহ উপবিধির ৩ কপি;
- সমবায় সমিতির সীলমোহরের নমুনা এবং
- আবেদনপত্রটি আইন অনুযায়ী যথাযথভাবে পূরণ করা হয়েছে এ মর্মে উদ্যোক্তাদের দেয়া ঘোষনাপত্র ।
নিবন্ধনপত্র সংগ্রহ
আবেদনপত্র জমা দেওয়ার পর সকল তথ্যাবলি ও কাগজপত্র যাচাই বাছাই করা হয়। সকল তথ্য ঠিক থাকলে ৬০ কার্যদিবসের ভিতর নিবন্ধক আবেদনকারীদের আবেদনপত্রে সম্মতি প্রদান করে। যদি কোনো কাগজে সমস্যা দেখা দেয় তবে ৩০ কার্যদিবসের মাঝে বাদ যাওয়া কাগজপত্র জমা দিতে বলা হয় এবং নিরুপন শেষ হলে নিবন্ধনপত্র ইস্যু করা হয়।
ইস্যু করার সময় নিবন্ধক খসরা নিতিমালার প্রতি পৃষ্ঠায় স্বাক্ষর ও সীল দিয়ে ২ কপি আবেদনকারীদের নিকট ফেরত দিবে এবং এক কপি অফিসে সংরক্ষণের জন্য রেখে দিবে। এই ক্ষেত্রে আবেদনকারী প্রতিষ্ঠানের সীলমোহরও অনুমোদিত বলে বিবেচিত হবে।
কার্যারম্ভ:
নিবন্ধন শেষ হলে সমিতিটি আইনগতভাবে অনুমোদিত প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা লাভ করবে এবং এর কর্মকর্তা ও উদ্যোক্তারা নিজেদের মাঝে আলোচনা সাপেক্ষে সমিতির কর্মকাণ্ড সুচনা করতে পারবে।
সমিতির আইন ও বিধিমালা:
সমবায় সমিতির আইন ও বিধিমালা অনেক ব্যাপক। বাংলাদেশ গেজেটে এই সকল বিধিমালা লিপিবদ্ধ রয়েছে। এই সকল বিস্তারিত আইনের মাঝে কিছু গুরুত্বপুর্ণ বিধিমালা উল্লেখ করা হলো:
১। সমবায় উপ-আইন অনুসারে যোগ্য ব্যক্তিকে সমবায়ের সদস্য হিসেবে মনোনয়ন করা যাবে।
২। কোনো ব্যক্তি সমবায় উপ-আইন অনুসারে যোগ্যতা হারালে তাকে সমবায় সমিতির সদস্যপদ থেকে অপসারণ করা হবে।
৩। সদস্যপদ গ্রহণের ক্ষেত্রে দুইটি বাঁধা বিবেচিত হতে পারেঃ
- সমিতির বিনিয়োগে অংশ না থাকা
- বয়স ১৮ বছর না হওয়া
৪। সমিতির কর্ম এলাকা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকতে হবে।
৫। নিবন্ধকের পুনঃঅনুমোদন ব্যতীত সমিতির নতুন কোনো শাখা খোলা যাবে না।
৬। সমিতির কোনো ভোট অনুষ্ঠিত করা হলে তা স্থানীয় নির্বাচন কমিশনের অনুমতি ও তত্বাবধান স্বাপেক্ষে করতে হবে।
৭। প্রাথমিক উপবিধি উপস্থাপনের সময় এর প্রয়োজনীয় তথ্য অবশ্যই জমা দিতে হবে।
৮। ৬০ কার্যদিবসের মাঝে যেকোনো সময়ে অনুমতি প্রদানের ক্ষমতা নিবন্ধক সংরক্ষণ করে।
৯। কোনো তথ্য কিংবা নথি জমা না পড়লে ৩০ কার্যদিবসের মাঝে সমবায় অফিস থেকে জানানো হবে।
১০। মুনাফা থেকে প্রাপ্ত টাকার সম্পুর্ণ বন্টন করা হবে না। এই ক্ষেত্রে ১৫% সঞ্চিত থাকবে এবং ৩% কল্যান তহবিলে জমা হবে।
১১। কমপক্ষে ২০ জন অংশিদারের উপস্থিতিতে সমবায় সমিতি গড়ে উঠবে।
১২। কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্য সংখ্যা কমপক্ষে ৬ জন হতে হবে। অংশিদার বেশি হলে পরিষদের সদস্য সংখ্যাও বেশি হবে।
সমবায় সমিতির সুবিধা:
সমবায় সমিতি বিভিন্ন রকমের সুবিধা প্রদান করে থাকে। এই সকল সুবিধার কারনেই মুলতঃ মানুষ সম্মিলিতভাবে এই ধরণের প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে আগ্রহ বোধ করে।
১। সমবায় সমিতি মুলধন তৈরিতে সাহায্য করে।
২। একত্রে একটি কাজ করা হলে কাজটি সহজ ও কম সময়ে করা যায়।
৩। উৎপাদনমুলক ক্ষেত্রে সমবায়ের মাধ্যমে কাজ করলে উৎপাদন ও পরিবহন ব্যয় কমে যায়।
৪। ঐক্যবদ্ধতা সমবায়ের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এর মাধ্যমে একজনের বিপদে অন্যজন সহজেই এগয়ে আসতে পারে।
৫। মধ্যসত্বভোগী গোষ্ঠীর অযাচিত শোষণ থেকে সমবায় সমিতি উৎপাদক শ্রেণীকে রক্ষা করতে পারে।
৬। দারিদ্র দূরিকরণে সমবায় সমিতি গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
৭। সততা, সহযোগীতা, ঐক্যবদ্ধতার অনুশীলন নৈতিকতার অবক্ষয় থেকে রক্ষা করতে পারে এবং মানুষকে সহনশীলতার শিক্ষা দিতে পারে।
৮। সমিতি করার মাধ্যমে অনেক দারিদ্র নিপিরিত মানুষের জীবনযাপনের মানের উন্নতি করা সম্ভব।
৯। অভিনব অনেক ব্যবসা একা করা সম্ভব না। সমবায় সমিতি করার মাধ্যমে কাজ ভাগ করে নেওয়ার মাধ্যমে অনেক অভিনব ব্যবসা করা সম্ভব।
১০। এই ধরণের প্রতিষ্ঠান অনেক সময় প্রাকৃতিক দূর্যোগে ত্রাণ বিতরণ, বৃত্তিমুলক শিক্ষা প্রদান ইত্যাদি উদ্যোগ গ্রহণ করে সামাজিক উন্নয়নে অবদান রাখে।
সমবায় সমিতির অসুবিধা:
বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ দারিদ্রসীমার নিচে বাস করে। এই দেশের জনগণের উন্নতিতে সমবায় সমিতির কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু এর পরেও আমাদের দেশে সমবায় সমিতি যতটা অবদান রাখার কথা ছিলো ততটা রাখতে পারে নি। এর পিছনে কিছু কারণ আছে। এই কারণগুলোকে সমবায় সমিতির অসুবিধা ও সীমাবদ্ধতা রূপে চিহিত করা যেতে পারে:
১। আইনী জটিলতা:
১৯৮৪ সালের সমবায় আইন ও ১৯৮৭ সালের সমবায় অর্ডিনেন্স সমবায় সমিতি প্রতিষ্ঠার মূল ভিত্তি। ২০০১ সালে পরিবর্তিত আইন পাশ হলেও গ্রামের অশিক্ষিত ও অর্ধশিক্ষিত জনগোষ্ঠির জন্য সকল নিয়ম মেনে চলে কাজ করা ও কার্যকর পরিষদ গঠণ করা কঠিন।
২। দীর্ঘসুত্রিতা:
বাংলাদেশের সমবায় আইন অনুসারে, অবেদনের প্রায় ৬০ কর্মদিবস সময়ের মাঝে নিবন্ধনের অনুমতি প্রদান করা হয় যা অনেক সময় সাপেক্ষ এবং এই ধরণের উদ্যোগ থেকে মানুষের আগ্রহ কমিয়ে দেয়।
৩। যোগ্যলোকের অভাব:
সমবায় সমিতি পরিচালনার জন্য যোগ্য কার্যকরী পরিষদ প্রয়োজন। যোগ্য লোককে কার্যকরী পরিষদে বসানো না হলে টাকা আত্মসাৎ, ভুল ব্যবসায় বিনিয়োগের মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে।
৪। দীর্ঘমেয়াদি কর্মযজ্ঞ:
সমবায় সমিতিতে তৎক্ষণাৎ লাভ পাওয়া সম্ভব নয়। এই ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিতে হয়। যা অনেকের ক্ষেত্রে আনাগ্রহ তৈরি করে।
৫। মুলধনের অভাব:
যেহেতু আমাদের দেশের বেশিরভাগ মানুষই দরিদ্র, তাই আমাদের দেশের বেশিরভাগ মানুষেরই মুলধনের অভাব রয়েছে। পর্যাপ্ত মুলধন যোগার করা না হলে সমবায় সমিতি পরিচালনা করা যায় না।
৬। নীতিমালা বিষয়ক জটিলতা:
সাধারণ মানুষের জন্য সমবায়ের নীতিমালা বেশ জটিল হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। এই কারণে নীতিমালা পালন ও মেনে চলা জনিত সমস্যা দেখে দিতে পারে। স্বদিচ্ছার অভাবও এই ধরণের সমস্যা জন্ম দেয়।
৭। স্বজনপ্রীতি ও দূর্নীতি:
আমাদের দেশে সমবায়ের আরোও একটি মারাত্মক সমস্যা হলো স্বজনপ্রতি ও দূর্নীতি। চতুর সদস্যদের দ্বারা পরিচালিত বিভিন্ন সমবায় সমিতিতে দূর্নিতির আশ্রইয় নিয়ে সাধারণ সদস্যদের ঠকানোর প্রবণতা দেখা যায়।
৮। পৃষ্ঠপোষকতার অভাব:
সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে বিভিন্ন সমবায় সমিতি আকাঙ্খিত সফলতা অর্জন করতে পারে না। এই কারনে দারিদ্র নিপিড়িত জনগোষ্ঠী দ্বারা পরিচালিত এই সকল প্রতিষ্ঠান বিকাশ লাভ করতে পারে না।
উপরের আলোচনা থেকে এই ব্যাপারটি প্রতিয়মান যে, সমবায় সমিতির অনেক সুবিধার পাশাপাশি কিছু অসুবিধা ও সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া সম্ভব হলে এই প্রতিষ্ঠানসমুহ এদের কর্মপরিধি ও কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করতে পারবে। এমনটা করা সম্ভব হলেই সমবায়ের মাধ্যমে সর্বোচ্চ সুফল পাওয়া সম্ভব।