সমবায় সমিতি কি? সমবায় সমিতির লক্ষ্য, উদ্দেশ্য এবং সাধারণ নীতিমালা সমূহ

সমবায় সমিতি কি? 

সমবায় এর সাধারণ অর্থ হলো সম্মিলিত প্রচেষ্ঠা। এই থেকে সমবায় সমিতির অর্থ দাড়ায় এমন একটি প্রতিষ্ঠান যা সম্মিলিত প্রচেষ্ঠাকে একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ প্রদান করে। তবে সমবায় সমিতির ব্যাপকতা আরো বিশাল। 

প্রকৃতপক্ষে সমবায় সমিতি হলো এমন একটি প্রতিষ্ঠান যেখানে একই শ্রেণী, পেশা কিংবা পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত কিছু মানুষ সমবায় আইনের অধীনে একটি পারস্পরিক সহায়তামুলক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে এবং এর মুল উদ্দেশ্য হলো পারস্পরিক সহযোগিতা এবং ভাগ্যের পরিবর্তন। 

একটি উদাহরণ দিলে ব্যাপারটি পরিষ্কার হবে। ধরুন, কোনো একটি গ্রামে কৃষকরা প্রচুর পরিমাণে সবজি উৎপাদন করে থাকে। এর পরে এই সকল সবজি ফড়িয়াদের (মধ্য স্বত্ত্বভোগী) মাধ্যমে শহরে বিক্রির জন্য পাঠানো হয়। দেখা গেলো, এই প্রক্রিয়াতে নাম মাত্র মুল্যে কৃষকরা সবজি বিক্রি করে দেয়, এতে তাদের তেমন কোনো লাভ থাকে না। 

এমন সময়, কৃষকরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে ঠিক করলো তারা সম্মিলিতভাবে ট্রাক ভাড়া করে নিজেরাই শহরে সবজি বিক্রি করবে। যা লাভ হবে এবং যা খরচ হবে তা সবজির শতকরা পরিমাণ হিসাবে সকলের মাঝে ভাগ হবে। এই পদ্ধতিতে দেখা গেলো কৃষকরা অধিক লাভ করতে পারছে। এই সম্মিলিতভাবে কাজ করার মাধ্যমে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনের প্রচেষ্টা ও ইচ্ছা থেকেই বিভিন্ন রকম সমিতির সুত্রপাত। 

প্রতিটি জিনিসই কিছু লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে গড়ে উঠে। সমবায় সমিতিও এর ব্যতিক্রম নয়।

যদিও এর প্রাথমিক ও মূল উদ্দেশ্য পারস্পরিক সহযোগীতা ও সম্পৃতি তৈরি হলেও এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা অত্যাবশ্যক: 

সমবায় সমিতির লক্ষ্যঃ

সমবায় সমিতির মুললক্ষ্য হলো পুজিবাদি বণিক, ধনী ও মধ্যস্বত্ত্বভোগী শ্রেণির হাত থেকে নিন্ম স্তরের মানুষকে রক্ষা করা হলেও এখন এর ব্যাপকতা শুধুমাত্র উৎপাদন মুলক পেশায় সীমাবদ্ধ নয়। বিভিন্ন ব্যবসা ও পরিষেবা, এলাকার ভিত্তিতেও সমবায় সমিতি গড়ে উঠছে। সমবায় সমিতির মূললক্ষ্যের ভিতরে রয়েছে: 

সংঘবদ্ধতা:
একই পেশা কিংবা একই শ্রেণির মানুষ একত্রিত হওয়ার ফলে সকলের মাঝে ভ্রাতৃত্ব তৈরি হয়। এর ফলে যে কোনো প্রকারের বিপদ আপদে কিংবা সমস্যায় বাইরের মানুষের নিকট না গিয়ে নিজেরাই সমাধান করা যায়। প্রয়োজনে সম্মিলিতভাবে আইনী সহযোগিতাও নেওয়া সম্ভব। 

মুলধন গঠন:

সমবায়ের আরো একটি অণ্যতম লক্ষ্য হলো নিজেদের মাঝে একটি মুলধন গঠন করা। একার পক্ষে একবারে হয়ত একটি মুলধন তৈরি করা অসম্ভব। কিন্তু সবাই সম্মিলিতভাবে ধীরে ধীরে একটি বড় পরিমাণের টাকা জমানো তুলনামুলক অনেক সহজ। 

আইনী ক্ষমতা লাভ:

সাধারণত সমবায় আইনের মাধ্যমে সমবায় সমিতি গড়ে তোলা হয়, এই কারনে এর আইনী স্বীকৃতি রয়েছে। একটি সমবায় সমিতি নিজের নামে মামলা দায়ের করার ক্ষমতা রাখে। 

সমস্যা সমাধান: 

সমিতির মাধ্যমে অনেকে নিন্ম আয়ের মানুষ নিয়মিত কিছু টাকা জমা দেওয়ার মাধ্যমে বিভিন্ন সমস্যা সমাধান করতে পারে। অনেকেই টাকা জমিয়ে ট্রাক্টর কেনা, গবাদী পশু কেনার মতো উদ্দ্যোগ নিয়ে থাকে। 

সমবায় সমিতির উদ্দেশ্য: 

সমিতির সমাজকল্যাণমূলক কার্যক্রম মানুষের কল্যাণের উদ্দেশ্যে পরিব্যাপ্ত হলেও সমবায় সমিতি আরোও বিভিন্ন উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে প্রতিষ্ঠিত হয়। 

১। সমবায় সমিতি একটি অরাজনৈতিক সংগঠন হিসাবে কাজ করা এবং দেশের প্রচলিত আইনে সমাজকল্যাণ সংগঠন হিসাবে রেজিষ্টার্ড থাকা।

২। সমাজসেবামূলক কাজে আইনসম্মত সমাজকল্যাণমূলক সংগঠনের সঙ্গে মত বিনিময় ও সহযোগিতা করবে।

৩। শিল্প সাহিত্যের উন্নয়ন ও শিক্ষা সংস্কৃতি বিকাশে কাজ করা।

৪। প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্থ/দুঃস্থ মানুষের সেবায় কাজ করা এবং অন্যান্য সমাজসেবামূলক সংস্থার সহযোগিতায় প্রয়োজনে বিনামূল্যে চিকিৎসার আয়োজন করা।

৫। বিভিন্ন পেশার মানুষের মধ্যে সামাজিক বন্ধন, সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যের ভাব গড়ে তোলা

৬। এই সমিতি সদস্যদের আপদে বিপদে সমবেদনা ও সহানুভূতি জ্ঞাপন করা এবং প্রয়োজনবোধে আর্থিক ও আইনানুগ সাহায্য ও সহযোগিতা প্রদান করা।

৭। এলাকার আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য কাজ করা।

৮। বেকার যুবকদের কর্মসংস্থানের উপযোগী নানা ধরনের বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা করা।

৯। গরীব ও মেধাবী ছাত্র/ছাত্রীদের বিনামূল্যে শিক্ষার উপকরণ বিতরণ ও বৃত্তি প্রদানের উদ্যোগ গ্রহণ করা।

১০। সর্বস্তরের মানুষ কিংবা শুধুমাত্র সদস্যদের নিয়ে মিলাদ মাহফিল, ঈদ পুনর্মিলনী, গুনীজন সংবর্ধনা, সেমিনার, আলোচনা সভা, গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় দিবস উদযাপন।

১১। জাতীয় আদর্শ ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করার জন্য বা সমিতির কার্যকরী পরিষদ কর্তৃক গৃহীত অন্য যে কোন কর্মসূচী বাস্তবায়নের জন্য এলাকার সম্ভ্রান্ত দানশীল ব্যাক্তি বা প্রতিষ্ঠান হইতে অর্থ সাহায্য বা প্রনোদনা গ্রহণ করা এবং তা সমিতির সদস্যদের মঙ্গলের জন্য রাষ্ট্রীয় লাইসেন্সধারী লাভজনক প্রতিষ্ঠান ও প্রকল্পে বিনিয়োগ করা।

উপরে উল্লেখিত উদ্দেশ্য সমূহকে সামনে রেখে সমবায় সমিতি গড়ে উঠে, তবে একটি ব্যাপার মাথায় রাখা দরকার আলাদা আলাদা সমবায় সমিতির উদ্দেশ্যও আলাদা আলাদা হয়। তাই সীমিত পরিসরে এর গণ্ডিবদ্ধ করা যাবে না। এবং এটিও আশা করা যাবে না যে সকল সমবায় উপরোক্ত সকল উদ্দেশ্য ধারণ করবে। 

সমবায় সমিতির সাধারণ নীতিমালা: 

সমাজের মানুষদের পারস্পরিক কল্যাণের লক্ষ্যে এই ধরণের প্রতিষ্ঠান তৈরি করা হলেও এর শীর্ষস্থানীয় এবং নেতৃস্থানীয় সদস্যাদের কিছু নীতিমালা মেনে চলতে হয়। সমবায় সমিতি যেন নিজের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য থেকে দূরে সরে না যায় এই কারণে এই সকল নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন খুবই গুরুত্বপুর্ণ। নিম্নে কিছু নীতিমালা উল্লেখ করা হলো: 

  1. “একতাই বল” এই মন্ত্রে উদ্ভাসিত হয়ে সকলে একত্রে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনের চেষ্টা করার মাধ্যমে এই প্রতিষ্ঠানকে সফল করে তুলবে। 
  2. সমবায়ের অন্তর্ভুক্ত যে কোনো সদস্য তার সামাজিক ও অর্থনৈতিক মর্যাদার পরিপ্রেক্ষিতে অধিক বা কম গুরুত্ব বহন করবে না। সকলকে সাম্যের ভিত্তিতে একই রূপ মর্যাদা প্রদান করতে হবে। 
  3. সমিতির অন্তর্ভুক্ত প্রতিটি মানুষ একে অপরের প্রতি সাহায্য-সহযোগিতামুলক মনোভাব বজায় রাখবে। 
  4. “সকলের তরে সকলে আমরা” - এই মুলনীতি অনুসরণ করে ব্যক্তিস্বার্থের উর্ধ্বে গিয়ে সকলের স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়া এবং একজন অপরজনের বিপদে এগিয়ে আসা। 
  5. সমিতির সকল সিদ্ধান্ত নিরপেক্ষতার সাথে গ্রহণ করা হবে। এই ক্ষেত্রে ধর্ম-বর্ণ-গোত্র কোনো প্রাধান্য পাবে না। 
  6. সমাবায় সমিতির সকল সিদ্ধান্ত সকলের সাথে পরামর্শ করে গ্রহণ করা হবে। প্রয়োজনে ভোটের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। 
  7. দেশ ও সমাজের উন্নতিতে অন্যান্য সকল সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের কাজের প্রতি সম্মান প্রদর্শন বাঞ্চনীয় এবং প্রয়োজনে প্রতিষ্ঠান সমুহের সাথে মিলিতভাবে কাজ পরিচালনা করা হবে। 
  8. সমাবায় সমিতিতে সততার কোনো বিকল্প নেই। এর অন্তর্ভুক্ত সকল সদস্যকে সততা ও নিষ্ঠার সাথে নিজের দ্বায়িত্ব পালন করতে হবে। 
  9. সমবায়ের কোনো সদস্য কোনো অসৎ পন্থা অবলম্বন করা করলে তাকে সমবায় আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে এবং প্রয়োজনে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধ করা হবে। 
  10. সমবায় সমিতির মাসিক জমা সময় মতো পরিশোধ করতে হবে। কেও দিতে অপারগ থাকলে পরিচালনা পরিষদকে আগে থেকে জানাতে হবে এবং অতিরিক্ত সময় বাড়িয়ে নিতে হবে। 
  11. কেও নিয়মিত অতিরিক্ত সময়েও দিতে অক্ষম হলে আলোচনা সাপেক্ষে সদস্যপদ সাময়িক অথবা দীর্ঘকালীন পর্যায়ে স্থগিত করা হতে পারে। 
  12. সমাবায়ে জমানো টাকা নিজের ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করা যাবে না। 
  13. সমাবায় সমিতির মাঝে প্রাপ্ত মুনাফা শতকরা পরিমাণের উপরে সমবায় আইন অনুসারে নন্টন করা হবে। 
  14. সমবায় আইন অনুসারে, মুনাফার সম্পূর্ণ অংশ বণ্টন না করে অর্জিত মুনাফার ১৫% সঞ্চিত রাখা এবং ৩% উন্নয়ন তহবিল বা কল্যাণ তহবিলে স্থানান্তর করা হবে। 
  15. যে কেও ইচ্ছা করলেই সমাবায় থেকে বেরিয়ে যেতে কিংবা সদস্যপদ প্রাপ্ত হতে পারবে না। 

সমবায় সমিতি জনগনের উন্নতি সাধনের উদ্দেশ্যে গঠন করা হয়। এর কিছু লক্ষ্য উদ্দেশ্য রয়েছে। এই সকল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পুরনের জন্য কিছু মুলনীতি পালন করা এবং মেনে চলা জরুরি। এই সকল মুলনীতি মেনে না চললে সমবায় সমিতি এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য থেকে পথভ্রষ্ট হয়ে পড়ে। এই কারণে প্রতিটি সমিতির প্রতিটি সদস্যকে নিয়মের প্রতি যত্নশীল হতে হবে।