একাউন্টিং এবং বুককিপিং কাকে বলে? Accounting এবং Bookkeeping এর মধ্যে পার্থক্য এবং ব্যবসার সফলতায় গুরুত্ব

ব্যবসা পরিচালনার ক্ষেত্রে একাউন্টিং এবং বুককিপিং হল ব্যবসায়িক কার্যক্রমের দুটি প্রধান দিক, যা আর্থিক তথ্য সংগ্রহ, লিপিবদ্ধকরণ, পরিকল্পনা এবং বিশ্লেষণ করার প্রক্রিয়া নিয়ে কাজ করে।

একাউন্টিং এবং বুককিপিং দুইটি বিষয়ই পরস্পরের সাথে সম্পর্কিত যা নিয়ে এই প্রবন্ধে বিশদভাবে আলোচনা করা হলো।

একাউন্টিং বা হিসাবরক্ষণ কাকে বলে?

ইংরেজি Accounting শব্দের বাংলা পরিভাষা হলো হিসাবরক্ষণ।  

Accounting বা হিসাবরক্ষণ হল এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে কোনো একটি কোম্পানি তার যাবতীয় আর্থিক লেনদেনের তথ্যসমূহ সংগ্রহ এবং সংরক্ষণকরণ, বিশ্লেষণ এবং রিপোর্টিং করা হয়, যাতে কোম্পানিটি তার আয়-ব্যয় এবং লাভ ক্ষতির সম্মক ধারণা পেতে পারে।

Accounting সাধারণত ব্যবসার আর্থিক অবস্থান, কার্যক্রমের ফলাফল এবং নগদ অর্থ প্রবাহের সঠিক এবং সময়োপযোগী তথ্য সরবরাহ করে।

এক কথায়, একটি ব্যবসার আর্থিক বিষয়ক বিজ্ঞানসম্মত হিসাব নিকাশের মাধ্যমকে একাউন্টিং বলে।    

বুককিপিং বা Bookkeeping কাকে বলে?

বুককিপিং বা Bookkeeping হলো Accounting প্রক্রিয়ার এর একটি মৌলিক অংশ যা ব্যবসার আর্থিক লেনদেনের যাবতীয় কার্যক্রম যেমন - আয়, ব্যয়, ক্রয়, বিক্রয়, পাওনা, পরিশোধ ইত্যাদি হিসাবের বইতে বা সিস্টেমে সুষ্ঠুভাবে লিপিবদ্ধ করা হয়। 

এটি ব্যবসার আর্থিক লেনদেনগুলি সংগ্রহ ও লিপিবদ্ধ করার প্রাথমিক ধাপ। সাধারণত প্রতি দিনের লেনদেনের ক্রমবর্ধমান হিসাব সঠিকভাবে সংরক্ষণ করতে সহায়তা করে। এতে ক্রয়-বিক্রয় রসিদ, চেক, ব্যাংক স্টেটমেন্ট এবং ইনভয়েসের মতো আর্থিক নথিসমূহ সংগ্রহীত থাকে।

Bookkeeping প্রক্রিয়ায় সাধারণত জার্নাল, লেজার এবং ট্রায়াল ব্যালেন্সের মতো হিসাবরক্ষণের রিপোর্ট সমূহ প্রদান করে থাকে।

আরো পড়ুন: বিজনেস মডেল কি? কিভাবে বিজনেস মডেল তৈরি করবেন?

একাউন্টিং ও বুককিপিং এর পার্থক্যঃ

বুককিপিং একাউন্টিং বা হিসাবরক্ষণ প্রক্রিয়ার মৌলিক অংশ এবং প্রাথমিক ধাপ হিসাবে কাজ করে। অনেকে Accounting এবং Bookkeeping এর মধ্যে পার্থক্য জানতে চায়। ব্যবসায় পরিচালনার ক্ষেত্রে চাহিদার উপর ভিত্তি করে এদের ব্যবহার হয়ে থাকে।  

বিস্তারিত আলোচনার মাধ্যমে এদের পার্থক্য তুলে ধরা হলো-

 

একাউন্টিং

বুককিপিং

উদ্দেশ্য 

একটি কোম্পানির হিসাব সংক্রান্ত তথ্য ও পরিসংখ্যান প্রদান করে।  

একটি ব্যবসার দৈনন্দিন লেনদেন সংরক্ষণের কাজে সহায়তা করে। 

ফলাফল 

কোম্পানির আর্থিক অবস্থান এবং নগদ অর্থ প্রদানের তথ্য সরবরাহ করে.

দৈনন্দিন ক্রমবর্ধমান লেনদেনের রেকর্ড সমূহ সঠিকভাবে সংরক্ষিত থাকে।

প্রতিবেদন

আর্থিক ব্যবস্থাপনায় ক্যাশ ফ্লো স্টেটমেন্ট, প্রফিট-লস স্টেটমেন্ট এবং ব্যালেন্স শিট প্রদান করে। 

এই প্রক্রিয়ায় লেজার, জেনারেল লেজার এবং ট্রায়াল ব্যালেন্স এর মত রিপোর্ট প্রদান করে

জটিলতা

জটিল এবং বিশ্লেষণাত্মক প্রক্রিয়া যা আর্থিক ডেটা ব্যাখ্যা এবং বিভিন্ন আর্থিক বিবৃতি তৈরির সাথে জড়িত।

তুলনামূলকভাবে সহজ এবং লেনদেনের মৌলিক রেকর্ডসমূহ পর্যায়ক্রমিকভাবে লিপিবদ্ধকরণের সাথে জড়িত। 

ব্যবহারকারী

বিভিন্ন স্টেকহোল্ডার দ্বারা ব্যবহৃত হয়, যার মধ্যে রয়েছে ব্যবস্থাপনা, বিনিয়োগকারী, ঋণদাতা ইত্যাদি।

প্রাথমিকভাবে ব্যবসার অভ্যন্তরীণ ব্যবহারের জন্য করা হয়। 

ভবিষ্যৎ কার্যক্রম

কোম্পানির বাজেট তৈরিতে বিনিয়োগে এবং ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে সহায়তা করে। 

ব্যবসার সঠিক হিসাব বজায় রাখতে এবং লাভ ক্ষতির সঠিক ধারণা পেতে সহায়তা করে। 

লিপিবদ্ধ করণ পদ্ধতি 

ব্যবসায় ভেদে accounting এর নানা রকম শাখা-প্রশাখা তৈরি হতে পারে। 

সাধারণত দুরকম হয়ে থাকে।  সিঙ্গেল এন্ট্রি ও ডাবল এন্ট্রি। 

 

ব্যবসায় সফলতায় একাউন্টিং এবং বুককিপিং এর গুরুত্বঃ 

একটি ব্যবসায় পরিচালনার জন্য মৌলিক অংশ হিসাবে কাজ করে একাউন্টিং ও বুককিপিং  প্রক্রিয়া। তাই ব্যবসায় সফলতায় এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।  

কোম্পানির আয়-ব্যায় এর রেকর্ড রাখা থেকে শুরু করে বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনা, হিসাব নিকাশ নথিভুক্ত করা ও আর্থিক তথ্য সরবরাহের কাজে সহায়তা করে।  

একাউন্টিং এবং বুককিপিং এর গুরুত্বসমূহ:

  1. হিসাব লিপিবদ্ধকরণ এবং সঠিক আর্থিক তথ্য
  2. আর্থিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ
  3. আর্থিক কাঠামো তৈরি
  4. কর নিয়ন্ত্রণ
  5. অডিট প্রস্তুতি বা ট্যাক্স ফাইলিং
  6. বাজেট তৈরি
  7. ঋণ বা বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণ
  8. ব্যবসার স্থায়ীত্ব বাড়ায়
  9. স্বয়ংক্রিয়তা এবং আধুনিকায়নে
  10. কৌশলী করে তোলে
  11. ব্যবসাকে শক্তিশালী করে

চলুন এদের গুরুত্ব সম্পর্কে জেনে নেয়া যাক-  

১.  সঠিক আর্থিক তথ্য বা হিসাব লিপিবদ্ধকরণ

ব্যবসার প্রতিটি আর্থিক লেনদেনের সঠিক রেকর্ড রাখার মাধ্যমে আর্থিক তথ্যের নির্ভুলতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করে। 

একাউন্টিং এর মাধ্যমে ব্যবসার আয়-ব্যয়, সম্পদ ও দায়, এবং নগদ প্রবাহের বিস্তারিত হিসাব সংরক্ষণ করা হয়, যা ব্যবসার আর্থিক অবস্থার পূর্ণাঙ্গ চিত্র প্রদান করে। সঠিক Accounting পদ্ধতি নিশ্চিত করে যে সব লেনদেন যথাযথভাবে শ্রেণীবদ্ধ এবং লেজারে লিপিবদ্ধ হয়েছে, ফলে আর্থিক রিপোর্টিং এর সময় কোন ভুল বা অসঙ্গতি দেখা যায় না। 

২. আর্থিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ

 হিসাবরক্ষণ এর মাধ্যমে ব্যবসার আর্থিক তথ্য বিশ্লেষণ করা যায়, যা ব্যবসায়িক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়ক হয়।  বিভিন্ন সময়ে নানা ধরনের আর্থিক বিপর্যয় সম্পর্কে অনুমান করা যায়। পরবর্তীতে সে অনুমান অনুযায়ী পরিকল্পনা গ্রহণ করা সহজ হয়।  

৩.  আর্থিক কাঠামো তৈরি করে

একটি ব্যবসার সফলতার জন্য শক্তিশালী আর্থিক কাঠামো অপরিহার্য, এবং একাউন্টিং এই কাঠামো তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এর মাধ্যমে সঠিক এবং সুষ্ঠু আর্থিক পরিকল্পনা, নিয়ন্ত্রণ এবং রিপোর্টিং সম্ভব হয়।

স্থান ও কাল ভেদে কিছু সময় ব্যবসার নীতি পরিবর্তন দেখা দিলেও একাউন্টিং ও বুককিপিং একটি ব্যবসার আর্থিক দিক সচল রাখতে মূল মেরুদণ্ড হিসেবে কাজ করে। 

৪. কর নিয়ন্ত্রণ

সঠিক বুককিপিং ও একাউন্টিং কর সম্পর্কিত জটিলতা কমায় এবং নিশ্চিত করে যে কোম্পানি সঠিক পরিমাণ কর প্রদান করছে।

এটি কর সম্পর্কিত আইন ও নিয়মাবলী মেনে চলার প্রক্রিয়া সহজ করে, ফলে কর ফাঁকি বা ভুল হিসাবের ঝুঁকি কমে যায়। Accounting এর সঠিক রেকর্ড রাখার ফলে কর নির্ধারণের সময় প্রয়োজনীয় তথ্য সহজে পাওয়া যায়, যা কর পরিশোধে স্বচ্ছতা ও নির্ভুলতা নিশ্চিত করে। 

৫. অডিট প্রস্তুতি বা ট্যাক্স ফাইলিং

সঠিক রেকর্ড ও আর্থিক বিবরণী প্রস্তুত করা হলে, অডিট প্রক্রিয়া সহজ হয়ে যায়। দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার উপর নির্ভর করে বিভিন্ন সময় লেনদেন সম্পর্কিত নিয়ম পরিবর্তন হয়ে থাকে।  এরকম সময় সরকারের বিভিন্ন ব্যবসায়ীক নীতির সাথে সহজে খাপ খাইয়ে নেয়া যায় একাউন্টিং এর মাধ্যমে। 

৬.  বাজেট তৈরিতে সাহায্য করে

একাউন্টিং এর মাধ্যমে ব্যবসার আয়ের উৎস এবং ব্যয়ের ক্ষেত্রগুলি চিহ্নিত করা যায়, যা সুনির্দিষ্ট এবং কার্যকরী বাজেট পরিকল্পনা করতে সাহায্য করে। এটি ব্যবসার পূর্ববর্তী আর্থিক তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করে, যা ভবিষ্যতের আয়-ব্যয় অনুমান করতে সহায়ক হয়। 

এছাড়া, সঠিক Accounting ব্যবসার আর্থিক স্থিতিশীলতা ও দক্ষতা বজায় রাখতে সহায়ক বাজেট প্রস্তুত করে, যা খরচ নিয়ন্ত্রণ, মুনাফা বৃদ্ধি এবং আর্থিক লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সহায়তা করে।

৭.  ঋণ বা বিনিয়োগ পেতে সহজ হয়

সঠিক ও সুষ্ঠু  হিসাবরক্ষণ ব্যবসার আর্থিক অবস্থা এবং কর্মক্ষমতা সম্পর্কে পরিষ্কার এবং নির্ভরযোগ্য তথ্য প্রদান করে, যা ঋণদাতা ও বিনিয়োগকারীদের আস্থা অর্জনে সহায়ক। 

একাউন্টিং এর মাধ্যমে প্রস্তুতকৃত আর্থিক বিবরণী, যেমন আয়-ব্যয় বিবরণী, ব্যালান্স শীট এবং নগদ-অর্থ প্রবাহের বিবৃতি, ঋণদাতা ও বিনিয়োগকারীদের কাছে ব্যবসার আর্থিক স্থিতিশীলতা ও সম্ভাবনা তুলে ধরে। 

এছাড়া, সঠিক  হিসাবরক্ষণ নিশ্চিত করে যে ব্যবসা তার আর্থিক বাধ্যবাধকতাগুলি সময়মত পূরণ করছে, যা ঋণদাতা ও বিনিয়োগকারীদের কাছে ব্যবসার প্রতিশ্রুতি পালন করার সক্ষমতা প্রদর্শন করে। ফলে, একাউন্টিং ব্যবসার ঋণ বা বিনিয়োগ প্রাপ্তি সহজতর করে এবং আর্থিক বৃদ্ধি ও সম্প্রসারণে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।

৮.  ব্যবসার স্থায়ীত্ব বাড়ায়

সঠিক হিসাবরক্ষণ পদ্ধতির মাধ্যমে খরচ নিয়ন্ত্রণ এবং আয়-বৃদ্ধির উপায় চিহ্নিত করা সহজ হয়, যা ব্যবসার আর্থিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করে। এছাড়া, একাউন্টিং বিভিন্ন আর্থিক ঝুঁকি সনাক্ত এবং মূল্যায়ন করে, যা ব্যবসাকে ঝুঁকি মোকাবিলায় প্রস্তুতি নিতে সহায়ক। 

 হিসাবরক্ষণ এর মাধ্যমে প্রাপ্ত সঠিক আর্থিক তথ্য ব্যবস্থাপনার কার্যকরী সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়ক হয়, যা দীর্ঘমেয়াদী ব্যবসায়িক কৌশল নির্ধারণ এবং বাস্তবায়নে সহায়তা করে। 

৯. স্বয়ংক্রিয়তা এবং আধুনিকায়নে

বর্তমানে ব্যবসার হিসাব রক্ষণ প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন ধরনের সফটওয়্যার ব্যবহারের মাধ্যমে আর্থিক ব্যবস্থাপনা কে আরো স্বয়ংক্রিয় এবং আধুনিক করে তোলে। 

১০.  কৌশলী করে তোলে

ব্যবসার সার্বিক দিক বিবেচনা করে কী ধরনের কৌশল ওই ব্যবসার আর্থিক ব্যবস্থাপনার জন্য অবলম্বন করতে হবে তা একাউন্টিং ও বুককিপিং এর মাধ্যমে বিবেচনা করা সম্ভব।  এতে করে পরবর্তী পদক্ষেপগুলো সঠিক কৌশলের মাধ্যমে সম্পন্ন করা সম্ভব হয়। 

কোম্পানির বিস্তার বাড়াতে সঠিক তথ্যকে কাজে লাগিয়ে প্রেজেন্টেশন তোইরি করা সহজ হয়।  যা পরবর্তীতে কোম্পানির জন্য ইনভেস্টর হান্ট বা ম্যানেজ করতে উপকারে আসে।  

১১.  ব্যবসাকে শক্তিশালী করে 

একাউন্টিং ও বুককিপিং ব্যবসার কর্মক্ষমতা মূল্যায়নে সহায়তা করে।  এটি ব্যবসার আর্থিক দিকগুলোর অবস্থানকে প্রতিফলিত করে।  একটি ব্যবসায় ঘটে যাওয়া সকল আর্থিক ওঠা নামা নিয়ে ধারণা প্রদান করে।  

ব্যবসার ছোট বড় সব ধরনের হিসাব সংরক্ষণের কার্যকরী মাধ্যম হিসেবে কাজ করে।  যার মাধ্যমে আপনি আপনার ব্যবসার মূল ভিত্তিকে শক্তিশালী করে গড়ে তুলতে পারবেন। 

একাউন্টিং এবং বুককিপিং একটি ব্যবসায় নিজ নিজ অবস্থানে যথাযথ ভূমিকা পালন করে যায়।  ব্যবসায় আলাদা বিনিয়োগকারী বা অংশীদার থাকলে তার বিভিন্ন জটিলতা থেকে বাঁচতে এগুলোর সহায়তা সম্পর্কে বলে শেষ করা যায় না। 

তাই, যে কোনো ব্যবসার এমনকি ব্যক্তিগত আর্থিক ব্যবস্থাপনার হিসাব ও লেনদেন সম্পর্কিত সকল পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্ত নিতে একাউন্টিং ও বুককিপিং এর কোনো বিকল্প নেই।