ব্র্যান্ড আইডেন্টিটি বা Brand Identity কি? কিভাবে ব্র্যান্ড আইডেন্টিটি তৈরি করবেন?

ব্র্যান্ড শব্দটা শুনলে প্রথমেই মনে যেটা আসে সেটা হলো, এটি একটি পণ্যের ক্লাস নির্ধারণ করে কারণ তা অন্যদের থেকে টেঁকসই, আলাদা এবং সময়োপযোগী।  আর এই ধারণাকে মাথায় গেঁথে দেবার জন্য একটি কোম্পানিকে পেছন থেকে অনেক কৌশল অবলম্বন করে জায়গাটিতে পৌঁছাতে হয়।  এক্ষেত্রে, ব্র্যান্ড আইডেন্টিটি আসলে কি জিজ্ঞাস করলে বলতে হয়, একটি ব্র্যান্ডের মানসিক ও সাংস্কৃতিক উপস্থাপনকে যতটা চাক্ষুষ উপলব্ধি করা যায় সেটাই ভোক্তার কাছে ওই ব্র্যান্ডের আইডেন্টিটি।  

ব্র্যান্ড আইডেন্টিটি বা Brand Identity কি?

কোনো কোম্পানির দৃশ্যমান উপাদান যেমন রঙ, লোগো, ট্যাগলাইন, ডিজাইনের প্রতি ভোক্তার আকর্ষণ তৈরি করতে, পণ্য বা সেবার মান সম্পর্কে ভোক্তার মনে জায়গা করে দিতে, পণ্যটিকে বা কোম্পানিকে প্রতিযোগীতায় টিকে থাকতে যে কৌশল অবলম্বন করা হয় সেটাই হলো ব্র্যান্ড আইডেন্টিটি বা Brand Identity।  

অর্থাৎ, একজন ভোক্তার কাছে একটি ব্র্যান্ড বা কোম্পানির পরিচয়।  একজন ভোক্তার মনে কিভাবে সেই কোম্পানি চিত্রিত হচ্ছে তা ব্র্যান্ড আইডেন্টিটির মাধ্যমেই বোঝা যায়। 

ব্র্যান্ডিং এবং ব্র্যান্ড আইডেন্টিটির মধ্যে পার্থক্য (Branding vs. Brand Identity) 

অনেকের কাছে ‘ব্র্যান্ডিং’ এবং ‘ব্র্যান্ড আইডেন্টিটি’ দুটো বিষয়কে এক মনে হতে পারে।  শুনতে প্রায় একই রকম মনে হলেও আসলে বিষয় দুটো পুরোপুরি আলাদা।  যেখানে Brand Identity একটি কোম্পানির পরিচয় বহণ করে সেখানে ব্র্যান্ডিং হলো সেই পরিচয়কে প্রচার করা।  

সহজ করে বললে, Brand Identity যদি একটি গান হয়ে থাকে তবে সেই গানকে বাজানো হলো ব্র্যান্ডিং।  কোম্পানির নাম থেকে শুরু করে যাবতীয় বিষয় এমন গ্রাহকের কাছ অব্দি পৌঁছানো ব্র্যান্ডিং এর কাজ।  ব্র্যান্ডিং এবং ব্র্যান্ড আইডেন্টিটি একে অপরের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত।   

ব্র্যান্ড আইডেন্টিটি যেভাবে তৈরি করা যায়ঃ

কোনো কোম্পানির ব্র্যান্ড আইডেন্টিটি তৈরি করা বেশ শক্ত কাজ।  বেশ কিছু বিষয়ের উপর লক্ষ্য রেখে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার মাধ্যমে এটিকে ধাপে ধাপে সম্পন্ন করতে হয়।  

কোনো শক্তিশালী, সমন্বিত এবং সামঞ্জস্যপূর্ণ ব্র্যান্ডের পরিচয় তুলে ধরতে যে পদক্ষেপগুলো নেয়া যেতে পারে তার একটা ধারণা উপস্থাপন করা যাক- 

  1. ব্র্যান্ডের নাম নির্ধারণ
  2. লোগো তৈরিকরণ
  3. রঙ নির্বাচন
  4. টাইপোগ্রাফি (Typography)  
  5. ব্র্যান্ড ভয়েস (Brand Voice)
  6. ব্র্যান্ড স্টোরি বা মেসেজ (Brand Story or Message)
  7. পণ্যের গুণগত মান
  8. বাজার বিশ্লেষণ 
  9. জনসম্পর্ক স্থাপন 

বিষগুলো সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হলো- 

১. ব্র্যান্ডের নাম নির্ধারণঃ 

যে নামে একটি ব্র্যান্ড পরিচিত হবে সেটা নির্বাচন করা একটা Brand Identity তৈরির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ।  নামের বুননের উপর নির্ভর করবে ভোক্তার কাছে সেই ব্র্যান্ডের মূল্যবোধ কতটা।  যে পণ্য বিক্রয় করা হবে সেই পণ্যের সাথে কতটুকু সংযোগ স্থাপন করে সেদিকটা মাথায় রেখেই ব্র্যান্ডের নাম নির্বাচন করা হয়।  

২. লোগো তৈরিকরণঃ

যেকোনো কোম্পানির জন্য লোগো অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটা বিষয়।  ব্র্যান্ডের লোগো একটি ব্র্যান্ডকে দৃশ্যমান হতে সাহায্য করে।  লোগো হতে পারে কোনো প্রতিক বা চিত্র, হতে পারে কোম্পানির পুরো নাম বা নামের অংশ।  যেখানে পরিচয় নিয়ে কথা বলা হচ্ছে সেখানে বলা যায়, একটি লোগো কোনো কোম্পানির পরিচয় বহন করতে সবচে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে।  লোগোকে কোম্পানির স্বীকৃত রূপ হিসেবে দেখা হয়ে থাকে।

৩. রঙ নির্বাচনঃ

রঙ একটি ব্র্যান্ডের জন্য খুবই দরকারি বিষয়।  পণ্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ রঙ বাছায় করে তা সেই ব্র্যান্ড প্রচারণার ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হলে ভোক্তার কাছে সেই রঙ সম্পর্কে আলাদা আবেগের সূচনা হয়।  একটি ব্র্যান্ডের আইডেন্টিটি যদি কোনো নির্দিষ্ট রঙ এর মাধ্যমে উপস্থাপিত হয় সেক্ষত্রে পরবর্তী স্ট্রাটেজিও অনেকটা সহজ হয়ে যায়। 

৪. টাইপোগ্রাফি (Typography):

প্রতিটা ব্র্যান্ডের একটি নির্দিষ্ট ট্যাগলাইন থাকে, যা দ্বারা ওই কোম্পানি বা তার সেবা সম্পর্কে ভোক্তা অল্প কথায় বুঝতে পারে।  এই ট্যাগলাইন থেকে শুরু করে প্রচারণায় ব্যবহৃত প্রতিটি উপকরণকে একটি নির্দিষ্ট টাইপোগ্রাফির আদলে ফেলে তৈরি করা যেতে পারে কোম্পানির নিজস্ব কিছু ফ্যাশন।

বিজ্ঞাপনে লেখার ফন্ট থেকে শুরু করে প্যাকেজিং, প্রচারণার লিফলেট, গিফট ভাউচারের উপকরণ বা রশিদেও এর ব্যবহার হয়ে উঠতে পারে আলাদা রকম।  এমনকি নির্দিষ্ট ব্র্যান্ডের ভিজুয়াল প্রেজেন্টেশনও এই অংশে বিশেষ সাহায্য করে থাকে।  এক্ষেত্রে অনেক সময় আলাদা কিছু প্যাটার্ন, আইকন বা গ্রাফিক্সের নানান ব্যবহার চোখে পড়ে।  

আরো পড়ুন: ব্যবসা শুরু করার আগে যে ১২টি বিষয় মনে রাখা জরুরি

৫. ব্র্যান্ড ভয়েস (Brand Voice):

লোগো বা ট্যাগলাইনের মতো ব্র্যান্ড ভয়েসও কোম্পানির পরিচয়কে সম্মুখে ফুটিয়ে তুলতে গুরুত্ব বহণ করে।  একটি ব্র্যান্ডে পরিচালিত বা ব্যবহৃত যেকোনো শব্দ, ভাষা, নিয়ম, আচরণ সেই ব্র্যান্ডটির মূল্যবোধকে অনেকাংশে গ্রহণযোগ্য করে তোলে।  এই মূল্যবোধের প্রতিফলন একটি ব্র্যান্ডের সামনের দিকে এগিয়ে যাবার গতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, যা ধীরে ধীরে ভোক্তার অভিজ্ঞতার অংশ হিসেবে জায়গা করে নেয়।  

৬. ব্র্যান্ড স্টোরি বা মেসেজ (Brand Story or Message):

যে কোম্পানিটি একটি সেবা প্রদানের জন্য পথ চলা শুরু করে তার পেছনে মুনাফা উপার্জন ছাড়াও নির্দিষ্ট কিছু উদ্দেশ্য থাকে।  কখনো কখনো সেটা একটি গল্পের মতো করে ব্র্যান্ডের ব্যাগগ্রাউন্ডে কাজ করতে পারে।  ভোক্তা যখন সেই আবেগকে নিজের সাথে মেলাতে শুরু করে তখন তার কাছে ওই ব্র্যান্ডটি একটি বিশেষ জায়গা দখল করে নেয়।  

ব্র্যান্ডটির ইতিহাস, মিশন এবং বিক্রয়ের প্রস্তাবনার পেছনে এই স্টোরি বা মেসেজটা কর্যকরী ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়।  এই কৌশলটি যেমন ভোক্তার সাথে ওই ব্র্যান্ডের মানসিক মেলবন্ধন তৈরি করে ঠিক সেই সাথে বাজারে উপস্থিত অনেক ব্র্যান্ড থেকে নিজেকে আলাদা করা সম্ভব হয়। 

৭. গুণগত মানঃ

ব্র্যান্ডকে যখন আইডেন্টিটি দেয়ার পরিকল্পনা করা হচ্ছে ঠিক সেই সময় ওই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে থাকে সুদূরপ্রসারী ব্যবসায় পরিচালনা করা।  এই পরিচয়টা যেন বছরের পর বছর ভোক্তাদের মাঝে টিকে থাকে।  আর এই লক্ষ্যে শুধুমাত্র বাহ্যিক আকর্ষণ বাড়িয়ে গেলেই চলে না, নজর রাখতে হয় ব্র্যান্ডের মূল জিনিস অর্থাৎ পণ্যের উপর।  

একটা কথা প্রচলিত আছে, “উপরে ফিটফাট, ভেতরে সদরঘাট”।  ব্র্যান্ড আইডেন্টিটি তৈরির পেছনে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে যদি এই কথাটির সাথে তা মিলে যায়।  পণ্যের মান ঠিক থাকলে একটি কোম্পানির ডেকোরেশন কখনো কখনো উপেক্ষা করা যায়।  কিন্তু প্রচারণায় অনেকটা ফোকাস থাকার পরও যদি পণ্য নিয়ে ভোক্তা সন্তুষ্ট না হয় তখন বিষয়টা গোড়াতেই শেষ হয়ে যায়।  তাই মানের দিকে নজর রেখেই আইডেন্টিটি তৈরির কাজে এগিয়ে যেতে হবে। 

৮. বাজার বিশ্লেষণঃ

নিজস্ব জায়গাগুলো পাকাপোক্ত করে একটি ব্র্যান্ডকে বাজার যাচাই করে দেখতে হয়।  SWOT Analysis এর মাধ্যমে কোম্পানির শক্তিশালী দিক, দূর্বলতা, সুযোগ, হুমকি বা আরও বিভিন্ন বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করে তারপরই বাকি পদক্ষেপের দিকে এগিয়ে যেতে হয়।  এতে করে প্রথম থেকেই বাজার সম্পর্কে পর্যাপ্ত ধারণা থাকে।  

কোন বিষয় খেয়ালে থাকলে নিজেদের পরিচয়কে অন্যদের থেকে আলাদাভাবে উপস্থাপন করা যায় এবং সকলের মাঝে দাঁড়িয়েও নিজের অবস্থানকে শক্ত করা যায় তা নির্ধারণ করা সহজ হয়।  

৯. জনসম্পর্কঃ

একটি ব্র্যান্ড তার পণ্যটিকে কেন্দ্র করে ভোক্তাদের সাথে যতটা সম্পর্ক তৈরি করতে পারে তার ব্র্যান্ডের পরিচয় ততটা ছড়িয়ে যেতে থাকে।  মূল লক্ষ্য সম্পর্কে যদি ভোক্তাকে আগ্রহী করে তোলা যায়, আচরণ ও মান দিয়ে যদি ভোক্তার বিশ্বাসকে শক্ত করা যায়, বিভিন্ন প্রচারণা যেমন সোশাল মিডিয়া, বিজ্ঞাপন, ইভেন্ট, স্পন্সরশীপসহ নানান মার্কেটিং স্ট্রাটেজির সাহায্য নেয়া যায় তা Brand Identity তৈরির কাজটিতে গতি প্রদান করে।  

ভোক্তা কি চায়, তার পছন্দ, সে কোন আচরণে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছে এই বিষয়গুলো ব্র্যান্ড আইডেন্টিটির ক্ষেত্রে এক রকম গবেষণাতুল্য।  

একজন ক্রেতা কিছু জিনিস সম্পর্কে জানার জন্য (দাম, পরিমাণ, সাইজ) আপনার কোম্পানির সাথে যোগাযোগ করলো, কোম্পানির পক্ষ থেকে তার সব চাহিদা যদি পূরণ হয়ে থাকে তবে এই আচরণের প্রতি ভোক্তার একটা মানসিক সংযোগ তৈরি হয়।  ওই মুহূর্তে সে পণ্যটি না কিনলেও আপনার কোম্পানিকে সে মনে রাখবে এবং একই পণ্য কেনার ক্ষেত্রে আপনার কোম্পানিকেই এগিয়ে রাখবে।  সেক্ষেত্রে কাস্টমার রিলেশনকে একটা কোম্পানির অনবদ্য অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। 

পরিশেষে বলা যায়, ব্র্যান্ড আইডেন্টিটি ছাড়া ভোক্তা কখনো একটি কোম্পানির সেবা সম্পর্কে জানতে পারে না।  যতক্ষণ পণ্য বা সেবা সম্পর্কে ধারণা তৈরি না হয় ততক্ষণ তার উপর আস্থাও আসে না।  

উপরিউক্ত বিষয়গুলো অনুসরণ করে এবং এর ধারাবাহিকতা, প্রাসঙ্গিকতা, ঐতিহ্য বজায় রাখার মাধ্যমে একটি শক্তিশালী ব্র্যান্ড আইডেন্টিটি তৈরি করা যায়, যা ওই কোম্পানির সামগ্রিক পরিচয় বহন করে।  এক্ষেত্রে ব্র্যান্ড আইডেন্টিটি শুধু পরিচয় গঠনের কাজেই নয় বরং নিজস্বতা ফুটিয়ে তুলতে, গ্রহণযোগ্যতা তৈরিতে এবং দীর্ঘস্থায়ীভাবে দণ্ডায়মান থাকতে আবশ্যক।  

সময়ের সাথে সাথে নিজের অবস্থানকে তুলে ধরতে, জনসাধারণের স্বার্থে নতুন আঙ্গিকে বারবার নিজেকে প্রমাণ করতে এবং বাজারের সাথে ক্রমাগত নিজেদের কর্মকাণ্ডকে মূল্যায়ন করতে সঠিক পদক্ষেপের মাধ্যমে এই ব্র্যান্ডের পরিচয় তৈরির কাজটি সম্পন্ন করা উচিত।