প্রযুক্তি নির্ভর এই বিশ্বে সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে ব্যবসার ধরণ। সনাতন পদ্ধতির ব্যবসার পাশাপাশি অনলাইনের মাধ্যমে বিভিন্ন রকমের ব্যবসা জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। এই অনলাইন ব্যবসার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত একটি শব্দ হলো ই-কমার্স।
বাংলাদেশে ই-কমার্স (E-Commerce in Bangladesh)
বিশ্বের অন্যান্য বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেও এর বিকাশ ঘটছে অবিশ্বাস্য গতিতে। নিজস্ব ওয়েবসাইট হোক কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ার পেইজ - এই ব্যবসা দিন দিন মানুষের মাঝে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। একই সাথে বাড়ছে নির্ভরযোগ্যতা ও বিশ্বস্ততা।
ই-কমার্স কি?
আসুন সংক্ষেপে জেনে নেওয়া যাক, ই-কমার্স আসলে কি। E-Commerce কে আমরা দুইটি আলাদা অংশে ভাগ করতে পারি, যেখানে E হলো ইলেক্ট্রনিক আর Commerce হলো ব্যবসা। অর্থাৎ ইলেকট্রনিক নেটওয়ার্ক, যেমন ইন্টারনেট ব্যবহার করে পণ্য ও সেবা ক্রয়-বিক্রয়, অর্থ লেনদেন এর মাধ্যমে সংগঠিত ব্যবসা হলো ই-কমার্স।
আরো সহজ কথায় বলতে হলে, ই-কমার্স হলো অনলাইনে বিভিন্ন ওয়েবসাইট কিংবা সোশ্যাল মিডিয়াকে ব্যবহার করে পণ্য ক্রয় কিংবা বিক্রয় করার পদ্ধতি যেখানে ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয় অনলাইনে যুক্ত থেকে লেনদেন সম্পন্ন করতে পারে।
বাংলাদেশে ই-কমার্সের যাত্রা
বাংলাদেশে এর যাত্রা শুরু হয়েছে খুব বেশি দিন আগে নয়। যদিও ২০০০ এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে বেশ কিছু অনলাইন প্রতিষ্ঠান মাথাচড়া দিয়ে উঠলেও ২০০৯ সালের আগ পর্যন্ত অনলাইন পেমেন্ট এর অনুমতি ছিল না। ২০০৯ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক অনলাইনের পেমেন্ট এর অনুমতি প্রদান করে। ২০১৩ এর দিকে ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে পেমেন্ট সুবিধা প্রদানের অনুমতি দেওয়া হয়। এই অনুমতি প্রদানের ফলে বাংলাদেশে বিভিন্ন বড় বড় ই- কমার্স সাইটের আগমন ঘটে যা আমাদের E-Commerce ইন্ডাস্ট্রিকে পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত করেছে।
ই-কমার্স এর প্রকারভেদ
এই ধরনের ব্যবসার কিছু নির্দিষ্ট ধরণ রয়েছে। ব্যবসার গ্রাহক ও বিক্রেতাকে এর উপরে ভিত্তি করে ৩টি মূল ভাগে ভাগ করা যেতে পারে।
এবার জেনে নেওয়া যাক কোন ধরণ আসলে কেমন এবং প্রকরণগুলো বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কি ধরনের বিকাশ লাভ করেছে।
Business to Business (B2B)
Business to Business বা B2B হলো এমন একটি ব্যবসায়িক মডেল যার মাধ্যমে একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান অপর একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কাছে পণ্য বিক্রয় করে থাকে। এই ক্ষেত্রে প্রথম পক্ষ সরাসরি গ্রাহক বা সর্বসাধারণের কাছে পণ্য বিক্রয় করে না।
একজন পাইকারি ব্যবসায়ী এক মূল্যে একজন খুচরা ব্যবসায়ীর কাছে পণ্য বিক্রয় করেন। এই ধারণার সাথে কম বেশি আমরা সকলেই পরিচিত। যদি এই পুরো কাজটিই করা হয় অনলাইনে, কোনো একটি ওয়েবসাইট এর মাধ্যমে তাহলে এই ব্যবসার ধরণ হবে B2B E-Commerce। যেমন Alibaba.
বাংলাদেশেও বিভিন্ন রকমের ওয়েবসাইট রয়েছে যারা এই সুযোগ প্রদান করে থাকে। bgmea.com.bd, bizbangladesh.com ইত্যাদি এই ধরনের ওয়েবসাইটের উদাহরণ। আবার বাংলাদেশে এমন অনেক প্রতিষ্ঠান রয়েছে যারা বিভিন্ন কোম্পানিকে বিভিন্ন কারিগরি সুবিধা প্রদান করে থাকে। যেমন, ওয়েব ডেভলপমেন্ট, সফটওয়্যার তৈরি ইত্যাদি। এই সকল প্রতিষ্ঠানও বি২বি এর উদাহরণ।
Business to Consumer (B2C)
বাংলাদেশে জনসাধারণের মাঝে সবচেয়ে জনপ্রিয় E-Commerce প্রকরণ খুব সম্ভবত Business to Consumer E-Commerce বা B2C। এই ব্যবসায়িক মডেলে একজন বিক্রেতা সরাসরি গ্রাহকের কাছে পণ্য বিক্রয় করে। পাইকারি কিংবা খুচরা বিক্রেতা যে কেওই সরাসরি গ্রাহকের কাছে অনলাইনের মাধ্যমে পণ্য বিক্রয় করলে তা B2C E-commerce হিসেবে পরিগণিত হবে।
বাংলাদেশে বিভিন্ন বি২সি ওয়েবসাইট রয়েছে। ফেসবুক ,ইন্সটাগ্রামের মতো সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করেও অনেকে এই ধরনের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে ওয়েবসাইটভিত্তিক প্রতিষ্ঠানসমূহের পরিসর অনেক ব্যাপক।
বাংলাদেশের কয়েকটি জনপ্রিয় B2C ওয়েবসাইট এর মাঝে রয়েছে:
- Daraz
- Chaldal
- Rokomari
- Foodpanda
- Othoba
- Pickaboo
- Ajkerdeal
- Sajgoj ইত্যাদি
Consumer to Consumer (C2C)
যখন একজন গ্রাহক থেকে অপর আরেকজন গ্রাহকের কাছে কোনো একটি পণ্য ক্রয় বিক্রয় করা হয় তখন তাকে Consumer to Consumer বা C2C বলা হয়। এই ক্ষেত্রে একজন গ্রাহকই সরাসরি আরেকজন গ্রাহকের কাছে নিজের ব্যবহার্য কিংবা অব্যবহার্য কোনো একটি পণ্য বিক্রয় করে থাকেন। এটি বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ব্যবসার অনুরূপ নিয়মিত করা হয় না।
রিসাইক্লিং, জিরো ওয়েস্ট, সার্কুলার ফ্যাশন ইত্যাদি সচেতনতা আন্দোলনের ফলে মানুষ নিজের অপ্রয়োজনীয় জিনিস দান কিংবা বিক্রয় করে দেয়। এতে যেমন তার কিছু টাকা আয় হয় তেমনিভাবে অপ্রয়োজনীয় একটি জিনিসও বাসা থেকে বের হয়। এই মর্মে বাংলাদেশে বিভিন্ন ওয়েবসাইট ও মোবাইল অ্যাপ গড়ে উঠেছে। এর মাঝে রয়েছে:
- Bikroy
- Cellbazar
- Ekhanei
- Keeno
- Recyle bin ইত্যাদি
আরো পড়ুন: বিনা পুঁজিতে শুরু করতে পারবেন এমন ২৫টি ব্যবসার আইডিয়া
ই-কমার্সের সাফল্যের কারণ
বাংলাদেশে ই-কমার্সের সফলতার পেছনে বেশ কিছু বড় কারণ রয়েছে। কিন্তু এমন দুই একটি কারণ আছে যা উল্লেখ না করলেই নয়:
১. ঘরে বসে কেনা কাটা
আমাদের দেশে গতিশীলতার যুগে প্রবেশ করেছে। মানুষের ব্যস্ততা, ট্র্যাফিক জ্যাম ইত্যাদি কারণে মার্কেটে গিয়ে শপিং করা অনেকের কাছে ঝক্কির কারণ। E-Commerce এর বিকাশের কারণে মানুষ ঘরে বসেই যে কোনো কিছু অর্ডার করতে পারে। একই সাথে অনেক অনেক পণ্য থেকে বেছে নিজের পছন্দ মতো পণ্য কিনতে পারে।
২. ক্রম বর্ধ্মান ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা:
এই বৃদ্ধির একটি কারণ হচ্ছে বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহার করে এমন মানুষের সংখ্যা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০২০ সালে, বাংলাদেশে ১৮.৩ মিলিয়নেরও বেশি ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ছিল, যা বর্তমানে আরোও বৃদ্ধি পেয়েছে। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক, কারণ এই সকল ব্যবহারকারীদের উপরে নির্ভর করেই বিভিন্ন পরিষেবা ও পণ্য বিক্রয় সম্ভব হবে। ৷
৩. সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা
বাংলাদেশ সরকার E-Commerce এর গুরুত্ব বোঝে এবং এর প্রবৃদ্ধিতে সহায়তা করার জন্য পদক্ষেপ নিচ্ছে। তারা ইন্টারনেট সম্পর্কে লোকেদের শেখানো, ভালো ইন্টারনেট পরিষেবাগুলিতে বিনিয়োগ করা এবং নিয়ম তৈরি করার মতো কাজ করে চলেছেন । এই প্রচেষ্টাগুলি এমন একটি পরিবেশ তৈরি করতে সাহায্য করবে যেখানে E-Commerce বৃদ্ধি পেতে পারে।
বাংলাদেশে ই-কমার্সের ভবিষ্যৎ
বাংলাদেশ, দক্ষিণ এশিয়ার একটি উন্নয়নশীল দেশ। প্রতিনিয়তই আমাদের দেশের E-Commerce বাজারে ব্যাপক বৃদ্ধি হচ্ছে। আমাদের সামনে সাফল্যের অনেকগুলো কারণ যেমন আছে তেমন বেশ কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে।
পরিসংখ্যান থেকে আমরা যা জানতে পাই:
একটি প্রতিবেদন অনুসারে, বাংলাদেশে বিদ্যমান এই বাজারটি ২০২৩ থেকে ২০২৭ সালের মধ্যে প্রায় ১৫.৭৫% বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা হচ্ছে, যা ২০২৭ সালের শেষ নাগাদ এর আনুমানিক মূল্য হবে প্রায় ১৩.৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি৷ এর মানে আমাদের দেশে অনলাইন ব্যবসার ভবিষ্যৎ আপাত দৃষ্টিতে উজ্জ্বল৷
ই-কমার্সের চ্যালেঞ্জ:
কিন্তু বাংলাদেশে ই-কমার্সের বিকাশ অব্যাহত রাখতে এমন কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে যা অতিক্রম করতে হবে। এই সকল চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করা না গেলেও আমাদের কাঙ্ক্ষিত উন্নতি সম্ভব হবে না।
- ভালো অবকাঠামোর অভাব
এসব চ্যালেঞ্জের মধ্যে একটি হলো ভালো অবকাঠামোর অভাব। দেশের কিছু অংশে, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে ইন্টারনেট সংযোগ এবং পণ্য সরবরাহের ব্যবস্থা খুব একটা ভালো নয়। এই সমস্যা একটি অনলাইন ব্যবসার ভালোভাবে পরিচালনা করতে বাঁধা প্রদান করে যা ব্যবসাটিকে আপামর জনসাধারণের কাছে পৌঁছে দেওয়াকে কঠিন করে তোলে। তাই অবকাঠামোগত উন্নতি অত্যাবশ্যক।
- বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন
আরেকটি চ্যালেঞ্জ হলো, বাংলাদেশের অনেক মানুষ অনলাইন শপিংকে এখনও বিশ্বাস করে না। তারা উদ্বিগ্ন যে তাদের ব্যক্তিগত তথ্য নিরাপদ নাও হতে পারে বা তারা প্রতারিত হতে পারে। আস্থা তৈরি করতে, ভোক্তা হিসাবে তাদের অধিকার এবং কীভাবে তাদের ব্যক্তিগত তথ্য রক্ষা করতে হয় সে সম্পর্কে মানুষকে আরও জানতে হবে। ব্যবসাগুলোকেও সৎ এবং নির্ভরযোগ্য হতে হবে যাতে লোকেরা অনলাইনে কেনাকাটা করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে।
- অর্থপ্রদান ব্যবস্থা:
মানুষ ক্রয়কৃত পণ্যের জন্য যেভাবে অর্থ প্রদান করে তাও অনেকক্ষেত্রে সমস্যা তৈরি করে। বাংলাদেশে, অনেকে এখনও অনলাইনে কিছু কেনার সময় নগদ অর্থ প্রদান করতে পছন্দ করেন। কিন্তু এটি ধীর এবং সুবিধাজনক নয়। মোবাইল ওয়ালেট বা অনলাইন ব্যাংকিংয়ের মতো ডিজিটাল পেমেন্ট পদ্ধতি ব্যবহার করলে আরও ভালো ফল পাওয়া সম্ভব। তাই এই ডিজিটাল পেমেন্ট অপশন প্রচার করা গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশে ই-কমার্স ব্যবসায় যে বিষয় গুলো মাথায় রাখতে হবে
একটি ব্যবসার উপরে নির্ভর করে একটি ই-কমার্স সাইট কেমন হবে। কি কি পণ্য রয়েছে, এই সকল পণ্যের গ্রাহক কিরুপ, তারা ই পছন্দ করে এমন বিভিন্ন বিষয় মাথায় রেখে এই ধরণের সাইট সমূহ তৈরি করা হয়। একটি E-Commerce ওয়েবসাইট তৈরির সময়ের নিচের বিষয়গুলো মাথায় রাখা জরুরি:
- যেসকল গ্রাহককে কেন্দ্র করে ব্যবসাটি আবর্তিত হবে তাদের চাওয়া এবং প্রয়োজনীয়তা নির্ধারণ ।
- এমন একটি কাঠামো নির্বাচন যা সেই প্রয়োজনীয়তাগুলি পূরণ করে।
- প্রয়োজনীয় উপাদান ও উপাত্তগুলো সনাক্তকরন
- একটি প্রোটোটাইপ তৈরি
- একটি ইকমার্স ওয়েবসাইট ডিজাইন এজেন্সির সরনাপন্ন হন
- ওয়েবসাইট লেআউট ডিজাইন করা
- বৃদ্ধির পর্যায়ে ধৈর্য ধারন
- আয় ব্যয় সংক্রান্ত ব্যবস্থাপনা নিশ্চিতকরন
সংক্ষেপে বলা যায়, বাংলাদেশে E-Commerce খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। কিন্তু এর ক্রমবর্ধমান উন্নতি অব্যাহত রাখার জন্য চ্যালেঞ্জসমূহ মোকাবেলা করা প্রয়োজন। অবকাঠামোর উন্নতি, আস্থা তৈরি করা এবং ডিজিটাল পেমেন্ট পদ্ধতির প্রচার সবই গুরুত্বপূর্ণ। সরকার এবং সকলের সহযোগিতায় একসাথে কাজ করার ফলে বাংলাদেশে ই-কমার্সের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ রয়েছে। এটি ব্যবসা এবং গ্রাহকদের জন্য অনেক সুবিধা নিয়ে আসবে, কেনাকাটাকে সবার জন্য সহজ এবং আরও সুবিধাজনক করে তুলবে৷