বাংলাদেশে গাড়ির প্রতি মানুষের আগ্রহ দিন দিন বেড়েই চলেছে। চাহিদা বেড়েছে আধুনিক, আরামদায়ক এবং টেকসই গাড়ির। কিন্তু এই চাহিদা মেটাতে দেশের নিজস্ব উৎপাদন খুবই সীমিত। তাই কার ইম্পোর্টিং কোম্পানিগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে আন্তর্জাতিক মানের গাড়ি দেশের বাজারে নিয়ে আসতে।
কার ইম্পোর্টারস বিজনেস
কার ইম্পোর্টারস বিজনেস বা গাড়ির আমদানি ব্যবসা হলো এমন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি, যারা বিদেশ থেকে নতুন এবং রিকন্ডিশন্ড গাড়ি আমদানি করে বাংলাদেশে বিক্রি করে।
তারা জাপান, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, দক্ষিণ কোরিয়া, এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশ থেকে Toyota, Honda, BMW, Mercedes-Benz এবং Hundai এর মতো ব্র্যান্ডের গাড়ি আমদানি করে। তার বিভিন্ন দেশের বিশ্বস্ত নিলাম হাউজ ও সরবরাহকারীর কাছ থেকে গাড়ি সংগ্রহ করে থাকে।
গাড়ির আমদানিকারকদের প্রকারভেদ
বাংলাদেশে গাড়ির আমদানিকারকদের সাধারণত কয়েকটি শ্রেণীতে ভাগ করা যায়:
- Recondition Car Importers
- Brand New Importers
- Luxary Car Importers
১. রিকন্ডিশন্ড গাড়ির আমদানিকারক: এরা সবচেয়ে বেশি প্রচলিত। তারা মূলত জাপান থেকে অনলাইন নিলামের মাধ্যমে ব্যবহৃত গাড়ি আমদানি করে। নতুন গাড়ির উপর উচ্চ আমদানি শুল্কের কারণে এই গাড়িগুলো প্রায়শই আরও সাশ্রয়ী হয়। বাংলাদেশের অনেক গাড়ির শোরুম এই রিকন্ডিশন্ড গাড়ি বিক্রিতে বিশেষজ্ঞ।
২. ব্র্যান্ড নিউ ইম্পোর্টারস/অথরাইজড ডিলার: এই কোম্পানিগুলো নির্দিষ্ট বিশ্বব্যাপী গাড়ির ব্র্যান্ডের অনুমোদিত পরিবেশক। তারা সরাসরি প্রস্তুতকারকদের কাছ থেকে নতুন ব্র্যান্ডের গাড়ি আমদানি করে। এই অংশটি সাধারণত উচ্চ-আয়ের গ্রাহক এবং কর্পোরেট ক্লায়েন্টদের সেবা দেয়।
৩. বিলাসবহুল গাড়ির আমদানিকারক: নতুন গাড়ির আমদানিকারকদের মধ্যে একটি বিশেষ অংশ, যারা BMW, Mercedes-Benz, Lexus ইত্যাদির মতো প্রিমিয়াম ব্র্যান্ডগুলিতে মনোযোগ দেয়। এই গাড়িগুলির উপর সাধারণত অত্যন্ত উচ্চ আমদানি শুল্ক আরোপিত হয়।
গাড়ির আমদানিকারকদের কার্যক্রম
গাড়ি আমদানিকারকরা গ্রাহকদের জন্য গাড়ি আমদানি থেকে বিক্রয়োত্তর সেবা পর্যন্ত বিভিন্ন ধাপে কাজ করে। তাদের প্রধান কাজগুলো হলো:
গ্রাহকের চাহিদা বিশ্লেষণ করা
গ্রাহকের বাজেট, পছন্দের ব্র্যান্ড, মডেল এবং গাড়ির ধরন (সেডান, এসইউভি, হাইব্রিড) মূল্যায়ন করা। উদাহরণস্বরূপ, মধ্যবিত্ত গ্রাহকরা টয়োটা কোরোলা বা প্রিমিও পছন্দ করেন, যেখানে উচ্চবিত্তরা বিএমডব্লিউ বা মার্সিডিজ চান।
সার্টিফিকেট যাচাই করে গাড়ি সংগ্রহ ও ক্রয়
আমদানিকারকরা সাধারণত জাপানের মতো দেশগুলোর অনলাইন অকশন হাউস থেকে ব্যবহৃত বা রিকন্ডিশন্ড গাড়ি কেনেন। তারা গাড়ির অবস্থা, মাইলেজ, মডেল এবং দামের উপর ভিত্তি করে গাড়ি নির্বাচন করেন। আমদানিকারকরা অকশন শিট এবং JAAI সার্টিফিকেট যাচাই করে গাড়ির গুণমান নিশ্চিত করে।
আমদানি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা
গাড়ি আমদানির জন্য ব্যাংকে এলসি খুলতে হয়, যা একটি আর্থিক গ্যারান্টি হিসেবে কাজ করে। আমদানিকারকগণ কেনা গাড়িগুলো বাংলাদেশে পাঠানোর জন্য শিপিং কোম্পানিগুলোর সাথে যোগাযোগ করে জাহাজে পরিবহনের ব্যবস্থা করেন। পরিবহনের সময় গাড়ির সুরক্ষার জন্য বীমার ব্যবস্থা করে থাকেন।
কাস্টমস ক্লিয়ারেন্সের জন্য প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টস জমা
বাংলাদেশে গাড়ি পৌঁছানোর পর, আমদানিকারকরা গাড়ির ইঞ্জিন ক্ষমতা, মডেল এবং প্রকারভেদের উপর ভিত্তি করে প্রযোজ্য আমদানি শুল্ক, সম্পূরক শুল্ক, ভ্যাট এবং অন্যান্য কর পরিশোধ করেন।
কাস্টমস ক্লিয়ারেন্সের জন্য রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট, এক্সপোর্ট সার্টিফিকেট, ইনভয়েস, এবং JAAI সার্টিফিকেট জমা দিতে হয়। এটি একটি জটিল প্রক্রিয়া এবং এতে প্রচুর নথিপত্রের প্রয়োজন হয়।
গাড়ির প্রস্তুতি ও রক্ষণাবেক্ষণ
রিকন্ডিশন্ড গাড়িগুলো বন্দরে পৌঁছানোর পর সেগুলোর প্রাথমিক পরিদর্শন করা হয়। প্রয়োজনে ছোটখাটো মেরামত, সার্ভিসিং বা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ করা হয় যাতে গাড়িগুলো বিক্রির জন্য প্রস্তুত হয়। গাড়িগুলোকে তাদের নিজস্ব শো-রুমে বা ডিলারশিপে প্রদর্শন করা হয় যাতে সম্ভাব্য ক্রেতারা গাড়িগুলো দেখতে পারেন।
গ্রাহকের পছন্দ অনুযায়ী কার কাস্টমাইজেশন
অনেক গ্রাহক তাদের গাড়িকে নিজস্ব পছন্দ অনুযায়ী কাস্টমাইজ করতে চান। Car Importers কোম্পানিগুলি এই চাহিদা পূরণে সহায়ক হয়। তারা গাড়ির রঙ, ইন্টিরিয়র ডিজাইন, অডিও সিস্টেম, আলো এবং অন্যান্য উপাদান কাস্টমাইজ করে দেয়। এর ফলে গ্রাহকরা তাদের পছন্দমতো গাড়ি পেতে পারেন।
মার্কেটিং ও প্রচার
বিভিন্ন বিজ্ঞাপন, অনলাইন প্ল্যাটফর্ম এবং ব্যক্তিগত যোগাযোগের মাধ্যমে গাড়ির প্রচার করা হয়। ক্রেতাদের গাড়ির বৈশিষ্ট্য, দাম, ঋণ সুবিধা এবং অন্যান্য তথ্য প্রদান করেন। ক্রেতাদের সাথে বিক্রয় চুক্তি সম্পন্ন করেন।
বিক্রয়োত্তর সেবা প্রদান
গাড়ির ওয়ারেন্টি, ফ্রি মেইনটেন্যান্স প্যাকেজ (যেমন, ১ মাসের ফ্রি সার্ভিস), এবং খুচরা যন্ত্রাংশ সরবরাহ। কিছু আমদানিকারক (যেমন, Continental Motors) হাইব্রিড ও ইলেকট্রিক গাড়ির জন্য বিশেষ ওয়ার্কশপ সেবা দেয়।
গাড়ির নিবন্ধনে সহায়তা করা
গাড়ি বিক্রির পর, আমদানিকারকরা ক্রেতাদের বিআরটিএতে গাড়ির নিবন্ধন প্রক্রিয়ায় সহায়তা করেন। এর মধ্যে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংগ্রহ ও জমা দেওয়া এবং নিবন্ধন ফি পরিশোধের নির্দেশনা প্রদান করা অন্তর্ভুক্ত।
বিক্রয়োত্তর সেবা প্রদান
কিছু আমদানিকারক গাড়ির ওয়ারেন্টি, সার্ভিসিং এবং যন্ত্রাংশ সরবরাহের মতো বিক্রয়োত্তর সেবাও প্রদান করেন। এটি গ্রাহকদের আস্থা অর্জনে সহায়ক হয়।
গ্রাহককে ব্যাংক ঋণ পেতে সহায়তা
আমদানিকারকগণ গ্রাহকদের ব্যাংক লোন পেতে সহায়তা এবং কিস্তিতে পেমেন্টের ব্যবস্থা করে থাকেন।
গাড়ির আমদানিকারকরা বিদেশ থেকে গাড়ি সংগ্রহ, আমদানি প্রক্রিয়া সম্পন্ন, শুল্ক পরিশোধ, গাড়ির ম্যানুফ্যাকচারিং, বিক্রয় ও বিতরণ, এবং বিক্রয়োত্তর সেবার মতো বহুমুখী কাজ করে বাংলাদেশের গাড়ির বাজারকে সচল রাখেন।
গাড়ি আমদানির বাজার পরিসংখ্যান
বাংলাদেশে গাড়ির চাহিদা বৃদ্ধির কারণে দ্রুত প্রসারিত হচ্ছে। বাংলাদেশে গাড়ি আমদানি বাজার ২০২৫ সালে উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে, যার মূল্য প্রায় ৫০০০ কোটি টাকা, এবং এটি প্রতি বছর ১৫-২০% হারে বাড়ছে।
জাপান থেকে রিকন্ডিশন্ড গাড়ির আমদানি এই বাজারের সিংহভাগ দখল করে রাখলেও, নতুন এবং বিলাসবহুল গাড়ির একটি নির্দিষ্ট বাজারও গড়ে উঠছে। রিকন্ডিশন্ড গাড়ির চাহিদা ৬৫% বেশি, কারণ এগুলো নতুন গাড়ির তুলনায় ৩০-৫০% সস্তা।
মার্কেট ইনসাইড এর তথ্যমতে, ডিসেম্বর ২০২৩ থেকে নভেম্বর ২০২৪ পর্যন্ত ৪২৪.১৪ মিলিয়ন ডলার মূল্যের প্রায় ৭৮.২২ হাজার চালান যানবাহন আমদানি হয়েছে।
বৈদেশিক মুদ্রার সংকটের কারণে সামগ্রিক আমদানি কিছুটা নিয়ন্ত্রিত হলেও, ২০২৩ সালে বিলাসবহুল গাড়ির আমদানি উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২২ সালে যেখানে প্রায় ২৩০টি উচ্চ-মানের গাড়ি আমদানি হয়েছিল, সেখানে ২০২৩ সালে এই সংখ্যা ৬১০টিতে পৌঁছেছে, যা তিন গুণেরও বেশি।
কীভাবে সেরা কার ইম্পোর্টার বেছে নেবেন?
গাড়ি কেনা একটি দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ। তাই সঠিক প্রতিষ্ঠান নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সেরা কার ইম্পোর্টার বাছাইয়ে নিচের বিষয়গুলো খেয়াল রাখতে পারেন:
ক. গাড়ির সনদপত্র ও গুণগত মান যাচাই
গাড়িটি কোন দেশে ব্যবহার হয়েছে, কোন অকশন হাউস থেকে কেনা হয়েছে, JAAI সার্টিফিকেট এবং অকশন শিট দেখাতে পারবে কিনা এবং গাড়ির প্রকৃত মাইলেজ ও কন্ডিশন সম্পর্কে সত্য তথ্য যাচাই করুন। নতুন গাড়ির ক্ষেত্রে: তারা কি সরাসরি প্রস্তুতকারকদের কাছ থেকে গাড়ি আমদানি করে, নাকি তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে? ওয়্যারেন্টি এবং বিক্রয়োত্তর সেবা দেয় কিনা জেনে নিন।
খ. সুনাম ও বিশ্বস্ততা আছে কিনা?
আমদানিকারকের সুনাম এবং গ্রাহক রিভিউ যাচাই করুন। যে আমদানিকারক দীর্ঘদিন ধরে এই ব্যবসায় আছে, তাদের অভিজ্ঞতা এবং বিশ্বস্ততা সাধারণত বেশি হয়।পূর্ববর্তী গ্রাহকদের সাথে কথা বলার সুযোগ থাকলে তাদের অভিজ্ঞতা জানুন।
গাড়ির মূল্য, শিপিং ফি, এবং কাস্টমস শুল্ক সম্পর্কে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করুন। কোনো হিডেন চার্জ আছে কিনা, সে বিষয়ে সতর্ক থাকুন। গাড়ির সকল বৈধ নথিপত্র সময়মতো এবং সঠিকভাবে প্রদান করতে পারবে কিনা, তা কনফার্ম হয়ে নিন।
ঘ. গাড়ির নিবন্ধন সহায়তা করবে কিনা?
বিভিন্ন আমদানিকারক বিআরটিএ নিবন্ধন প্রক্রিয়ায় সহায়তা করে। এটি আপনার সময় ও শ্রম বাঁচাবে। এছাড়া তারা কি ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে গাড়ি কেনার জন্য ঋণ সুবিধা এবং কিস্তি সুবিধা দিবে কিনা যাচাই করুন।গাড়ি কেনার আগে টেস্ট ড্রাইভের সুযোগ আছে কিনা, তাও জেনে নিন।
ঙ. বিক্রয়োত্তর সেবা ও ওয়ারেন্টি
আমদানিকারকের নিজস্ব সার্ভিস সেন্টার আছে কিনা এবং দক্ষ টেকনিশিয়ান আছে কিনা জিজ্ঞাসা করুন। গাড়ির ইঞ্জিন, গিয়ারবক্স বা অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাংশের জন্য কোনো ওয়ারেন্টি প্রদান করা হয় কিনা, তা জেনে নিন। নতুন গাড়ির জন্য প্রস্তুতকারকের ওয়ারেন্টি সম্পর্কে নিশ্চিত হোন।
ভবিষ্যতে গাড়ির কোনো যন্ত্রাংশের প্রয়োজন হলে, সেগুলো সহজে পাওয়া যাবে কিনা বা আমদানিকারক সরবরাহ করতে পারবে কিনা, তা জেনে নিন।
আমদানিকারক BARVIDA (Bangladesh Reconditioned Vehicles Importers and Dealers Association) সদস্য এবং সরকারি নিবন্ধনপ্রাপ্ত কিনা যাচাই করুন।
কার ইম্পোর্টার কোম্পানি শুধু গাড়ি বিক্রেতা নয়—তারা আপনার স্বপ্নের গাড়িটি সঠিকভাবে বাছাই, নিরাপদে আমদানি এবং আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে আপনার হাতে তুলে দেওয়ার দায়িত্বে থাকে। বাংলাদেশে গাড়ি আমদানি ব্যবসা ক্রমবর্ধমান শুল্ক হ্রাস এবং রিকন্ডিশন্ড গাড়ির জনপ্রিয়তার কারণে সমৃদ্ধ হচ্ছে। সেরা আমদানিকারক বাছাইয়ে বিশ্বাসযোগ্যতা, গাড়ির গুণমান, সেবার বৈচিত্র্য, এবং খরচের স্বচ্ছতা বিবেচনা করুন।