বাংলাদেশের আর্ট এবং হ্যান্ডিক্রাফট পণ্যে দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য, সৌন্দর্য এবং নৈপুণ্য বিদ্যমান। এ শিল্প ছিল আদি ও মধ্যযুগীয় বাংলার গুরুত্বপূর্ণ শিল্প। বাংলাদেশের হ্যান্ডিক্রাফট অধিকাংশই গ্রামীণ এলাকার একেকটি পণ্য উৎপাদন ইউনিট।
সুই-সুতার পাশাপাশি বাঁশ, বেত, মাটি, পাট, কাঁসা-পিতল, কাঠ, হোগলাসহ নানা উপকরণ দিয়ে তৈরি পণ্য, নকশিকাঁথা, হাতে তৈরি তৈজসপত্র, কাঁসা–পিতল ও কাঠের তৈরি ফুলদানি, মোমদানি ও কলমদানি, কাঠের কারুকাজ করা বিভিন্ন পণ্য, ব্যাগ, ঘরকন্নার বিভিন্ন উপকরণ, পোশাক ইত্যাদি নানা কিছু এসব শিল্পের আওতায় পড়ে।
আর্ট এবং হ্যান্ডিক্রাফট
আর্ট বলতে বোঝায় সৃজনশীলতার মাধ্যমে তৈরি করা বিভিন্ন ধরনের চিত্রকলা, ভাস্কর্য, ফটোগ্রাফি এবং অন্যান্য ভিজ্যুয়াল আর্ট। অপরদিকে, হাতের তৈরি শিল্পকেই সাধারণত হস্তশিল্প বলে। হস্ত ও কারুশিল্প হচ্ছে হাতের কাজে তৈরি নানা ধরনের শিল্পকর্ম, যা সাধারণত স্থানীয় উপকরণ এবং সনাতন পদ্ধতি ব্যবহার করে তৈরি করা হয়। এটি একটি সৃজনশীল প্রক্রিয়া যেখানে হাতের দক্ষতা ও নিপুনতার মাধ্যমে তৈরি হয় নান্দনিক ও ব্যবহারিক জিনিসপত্র। যেমন,- নকশিকাঁথা, শীতল পাটি, ফুলদানি, কলমদানি, ব্যাগ, ঘরের বিভিন্ন উপকরণ ইত্যাদি।
বিভিন্ন ধরণের আর্ট এবং হ্যান্ডিক্রাফট শিল্প
নিচে বিভিন্ন ধরণের আর্ট এবং হ্যান্ডিক্রাফট শিল্পের একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ প্রদান করা হলো:
আর্ট শিল্পের ধরণঃ
১. চিত্রকর্ম: বিভিন্ন রঙ, মাধ্যম এবং কৌশল ব্যবহার করে স্থানীয় ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির অথবা আধুনিক শৈলীর উপর ভিত্তি করে তৈরি করা বিভিন্ন চিত্রকর্ম। এছাড়া কাপড়ের উপর বিশেষ রঙ এবং মোম ব্যবহার করে বুটিক করা হয়।
২. ভাস্কর্য: ভাস্কর্য একটি গুরুত্বপূর্ণ আর্ট ফর্ম যেখানে মাটি, পাথর, ধাতু এবং কাঠের মতো বিভিন্ন উপকরণ ব্যবহার করে মূর্তি এবং ত্রিমাত্রিক শিল্পকর্ম তৈরি করা হয়।
৩. ক্যালিগ্রাফি: ক্যালিগ্রাফি হলো এমন একটি শিল্প যেখানে অক্ষর এবং শব্দগুলোকে শৈল্পিকভাবে সাজানো হয়।
হস্ত শিল্পের ধরণঃ
১. মৃৎশিল্প: আমাদের দেশে এই শিল্পের ব্যবহার সেই আদিকাল থেকে। মাটি দিয়ে তৈরি সব শিল্পকর্ম মৃৎশিল্প হিসেবে পরিচিত। যেমন,- মাটির তৈরি হাড়ি-পাতিল, কলসি, থালা, বাটি, ফুলের টব, ফুলদানি, ব্যাংক, খাবার টেবিল, খেলনা, সৌখিন সামগ্রী ইত্যাদি।
২. নকশি কাঁথা: নকশি কাঁথা হলো সাধারণ কাঁথার উপর নানা ধরণের নকশা করে বানানো বিশেষ প্রকারের কাঁথা। নকশি কাঁথা শত শত বছরের পুরনো বাংলাদেশের সংস্কৃতির একটা অংশ। নকশি কাঁথা বাংলাদেশের লোকশিল্পের একটা অংশ। সাধারণত পুরাতন কাপড়ের পাড় থেকে সুতা তুলে অথবা তাঁতীদের থেকে নীল, লাল, হলুদ প্রভৃতি সুতা কিনে এনে কাপড় সেলাই করা হয়।
৩. বাঁশ এবং বেতের কাজ: বাঁশ এবং বেত দিয়ে তৈরি ঝুড়ি, চেয়ার, টেবিল, আসবাবপত্র এবং অন্যান্য ব্যবহার্য সামগ্রী।
৪. পাথরের কাজ:পাথর দিয়ে তৈরি মূর্তি, স্মারক, টাইলস, রত্ন ইত্যাদি।
৫. পাটের পণ্য: পাট দিয়ে তৈরি ব্যাগ, ম্যাট, দড়ি ইত্যাদি।
৬. কাঠের কাজ: কাঠ দিয়ে তৈরি বিভিন্ন আসবাবপত্র, সৌখিন জিনিসপত্র, ফ্রেম ইত্যাদি।
৭. ধাতুশিল্প: তামা, পিতল, ব্রোঞ্জ, রুপা, সোনা ইত্যাদি ধাতু দিয়ে তৈরি থালা-বাসন, অলংকার, ভাস্কর্য, ল্যাম্প, ঘড়ি, ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতির আনুষাঙ্গিক ইত্যাদি।
এ শিল্পের সাধারণ পরিসংখ্যান
বাংলাদেশের আর্ট এবং হ্যান্ডিক্রাফট শিল্প দেশের অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের হস্ত ও কুটির শিল্পজাত পণ্যের বিশাল চাহিদা। হস্ত ও কারুপণ্যে পরিবেশবান্ধব হওয়ায় এর বৈশ্বিক চাহিদাও দিন দিন বাড়ছে।
প্রায় ২০ লক্ষ লোক সরাসরি হস্তশিল্পের সাথে যুক্ত, যার মধ্যে বেশিরভাগই নারী। এ শিল্প জিডিপির প্রায় ৭% অবদান রাখে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ২০২২ সালে হস্ত ও কারুশিল্প নিয়ে একটি জরিপ করে। তাতে দেখা গেছে, দেশে হস্ত ও কারুশিল্পের বাজার ২ হাজার ৪৩০ কোটি টাকার ওপরে। প্রতিবছর এই বাজার বাড়ছে।
বাজার বিশ্লেষক ওয়েবসাইট আইএমএআরসির তথ্য অনুসারে, ২০২৩ সালে হস্তশিল্পের বৈশ্বিক বাজার ছিল প্রায় ৮৩ হাজার কোটি মার্কিন ডলারের। এই খাতে বছরে ৯ শতাংশের ওপরে প্রবৃদ্ধি রয়েছে। সে অনুযায়ী ২০৩২ সাল নাগাদ এই বাজার ১ লাখ ৮৬ হাজার কোটি ডলারে পৌঁছাতে পারে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, বাংলাদেশের সামনে এখন বিশাল এই বাজারের সম্ভাবনা কাজে লাগানোর সুযোগ তৈরি হয়েছে।
আর্ট এবং হ্যান্ডিক্রাফট কম্পানি বাছাইয়ের গুরুত্বপূর্ন দিকগুলো
আর্ট এবং হ্যান্ডিক্রাফট কম্পানি বাছাই করার সময়, আপনার চাহিদা ও পছন্দ, কম্পানির গুণমান ও খ্যাতি, দাম ও মূল্য, পরিবহন ও বিতরণ ব্যবস্থা, গ্রাহক পরিষেবা এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো বিবেচনা করা গুরুত্বপূর্ণ। নিম্নে এগুলো তুলে ধরা হলোঃ
১. আর্ট এবং হ্যান্ডিক্রাফট পণ্যের ক্ষেত্রে মান এবং নৈপুণ্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কোম্পানির পণ্যগুলির গুণগত মান যাচাই করুন। ভালো মানের পণ্য দীর্ঘস্থায়ী হয় এবং এটি কারিগরের দক্ষতার প্রমাণ বহন করে।
২. কোম্পানি যে উপকরণগুলি ব্যবহার করে সেগুলি পরিবেশবান্ধব এবং টেকসই কিনা তা যাচাই করুন।
৩. পণ্যের মান ও পরিষেবার সাথে বিভিন্ন কম্পানির দামের সাথে তুলনা করুন।
৪. কম্পানির সুনাম অভিজ্ঞতা যাচাই করুন। প্রোডাক্ট এবং কম্পানির রিভিউ পড়ুন অনলাইনে। অন্যান্য ক্রেতাদের অভিজ্ঞতা এবং মতামত থেকে আপনি কোম্পানির পণ্যের মান এবং সেবার সম্পর্কে ধারনা পাবেন।
৫. কোম্পানির পণ্যগুলির নকশা এবং সৃজনশীলতা পর্যালোচনা করুন।
পরিশেষে, হস্তশিল্প আমাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। এর উন্নয়ন ও অগ্রগতির জন্য সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন।